রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি-অর্থনীতির চিত্র বদলে দিতে পারে আম রপ্তানি

বাসস
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৮:৫৫
ছবি: বাসস

মো. আয়নাল হক

রাজশাহী, ১০ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): নওগাঁর সোহেল রানা চলতি বছরের ২৫ জুন থেকে ১ জুলাই কাতারের সুক ওয়াকিফে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী ‘বাংলাদেশি ম্যাংগো ফেস্টিভাল ২০২৫’-এ অংশ নেন। তিনি সেখানে ৪ হাজার ৫০০ কেজি আম নিয়ে গিয়েছিলেন, পরিবহন খরচসহ যার কেজি প্রতি ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৫০ টাকা।

সৌভাগ্যক্রমে তিনি ওই আম কেজি প্রতি ৫০০ টাকা দরে প্রায় ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। অথচ বাংলাদেশের বাজারে মৌসুমি এই ফলগুলোর বিক্রয় মূল্য সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। 

নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় এ বছর আম্রপালি আম গড়ে কেজি প্রতি ৭৫ টাকায় বিক্রি হলেও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে তা বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৫০০ টাকায়।

ফলে বিদেশে আম রপ্তানি হলে অসংখ্য কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতেও আসতে পারে বড় পরিবর্তন।

সম্প্রতি কাতারের এই ম্যাংগো মেলা থেকে ফিরে সাপাহারের বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল রানা এ সম্ভাবনার কথা জানান।

তিনি প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে আম চাষ করেন এবং ২০২১ সাল থেকে সীমিত পরিসরে ইউরোপের বাজারে আম রপ্তানি করছেন।

রাজশাহী অঞ্চলের আম রপ্তানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আমের আবাদ ও উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে, আর মুনাফার কারণে ক্রমশ বেশি সংখ্যক কৃষক আম চাষে ঝুঁকছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আজিজুর রহমান জানান, এ অঞ্চলে আম উৎপাদন বেড়েছে এবং রপ্তানি বাড়াতে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। 

গত এক দশকে আমের বাগান ও উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে, যা এ অঞ্চলের কৃষি খাতের বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কৃষকরা ক্রমেই তিন ফসলি ধানখেত আমের বাগানে রূপান্তর করছেন, যা আম চাষের লাভজনক দিকটি স্পষ্ট করছে।

রাজশাহী অঞ্চল থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার আম রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান ড. আজিজুর রহমান।

তিনি বলেন, সরকার কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আমের রপ্তানি মূল্য বাড়াতে সংযোজন মূল্য বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে।

রপ্তানিযোগ্য উচ্চমানের আম নিশ্চিত করতে উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংগ্রহ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, তাজা শাকসবজি ও ফলের সরাসরি রপ্তানি সহজ করতে রাজশাহী বিমানবন্দর উন্নত করার দাবিও উঠেছে।

স্বাদ ও রপ্তানিযোগ্যতার জন্য গোবিন্দভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর, রানীপছন্দ, ফজলি ও আশ্বিনা আম বিশেষভাবে পরিচিত। 

রাজশাহী জেলার পবা, চারঘাট ও বাঘা, নওগাঁ জেলার সাপাহার ও পোরশা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ, কানসাট, রোহনপুর ও সদর উপজেলা উচ্চমানের আম উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ।

নওগাঁ জেলার আম রপ্তানির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। বাড়ছে আম চাষ, আর রপ্তানিযোগ্য মান বজায় রাখতে ফল মোড়ানোর (ফ্রুট ব্যাগিং) পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে, যা রপ্তানি সম্ভাবনা আরও বাড়াচ্ছে।

শনিবার বাসস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মনজুরুল হুদা বলেন, লাভজনক দিক বিবেচনায় নওগাঁয় ধানসহ অন্যান্য ফসলের পরিবর্তে আম চাষ বাড়ছে।

ফল মোড়ানোর মতো আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে কৃষকরা রপ্তানিযোগ্য মানের আম উৎপাদন করতে পারছেন, যা কীটনাশকের প্রয়োজন কমাচ্ছে এবং ফলমাছি সংক্রমণও হ্রাস করছে।

নওগাঁর আম এখন ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাচ্ছে। চীনেও রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। এতে রপ্তানি গন্তব্য বৈচিত্র্যময় হচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়ছে।

চলতি মৌসুমে নওগাঁয় আম উৎপাদন এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যার বড় একটি অংশ রপ্তানির জন্য নির্ধারিত।

সরকার রপ্তানিকারকদের প্রণোদনাও দিচ্ছে, যা অঞ্চলটির আম রপ্তানি আরও উৎসাহিত করছে। তবে ইতিবাচক চিত্র সত্ত্বেও বাড়তি বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধার প্রয়োজন রয়েছে। আম প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে উঠলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে সংযোজন মূল্য যোগ হয়ে তা আরও শক্তিশালী হবে।

রাজশাহী অ্যাগ্রো ফুড প্রোডিউসার সোসাইটির সভাপতি আনোয়ারুল হক জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজশাহীর আম ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন সুযোগ খুলে দিয়েছে। ফল মোড়ানোর পদ্ধতির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফলে কীটনাশকমুক্ত আম উৎপাদন সম্ভব হয়েছে, যা ফলমাছির আক্রমণও কমিয়েছে।

তিনি বলেন, কৃষি চর্চা বিষয়ে ভালো মানের প্রশিক্ষণের ফলে অনেক কৃষক ও মূল্য শৃঙ্খলের অংশীদাররা উচ্চমূল্যের রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করতে পারছেন।

যদিও রপ্তানির লাভ স্থানীয় বিক্রির প্রায় দ্বিগুণ, তবে এতে বেশি বিনিয়োগ, যত্ন এবং আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োজন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, এ অঞ্চলে ধান ও আলুর পর আম এখন তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য হিসেবে ওঠে এসেছে। তবে তিনি রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, এ অঞ্চলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ আম উৎপাদন হলেও রপ্তানি হয় সামান্য পরিমাণ। আমাদের আরও বিদেশি বাজার খুঁজতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ফ্রান্সে ভয়াবহ দাবানল নিয়ন্ত্রণে এনেছে দমকলকর্মীরা
খিলক্ষেতে চাঁদাবাজ ‘ফরমা রনি’ আটক
সাংবাদিক তুহিন হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে কচুয়ায় মানববন্ধন
হেফাজতে মৃত্যু: জনি হত্যায় পুলিশের কারাদণ্ড ও ক্ষতিপূরণের রায়
টাঙ্গাইলে কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও সম্মানী প্রদান
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষে বাগেরহাটে ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা অভিযান
লক্ষ্মীপুরে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের সমাবেশ
শিক্ষার্থী খালিদ হত্যা: সাবেক এমপি সোলাইমান সেলিম ফের রিমান্ডে
লক্ষ্মীপুরে ২৩ মামলার আসামিসহ দুইজন গ্রেপ্তার
অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে ধারাবাহিক অভিযানে জরিমানা আদায় ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন
১০