।। মো. সাকিব আল তানিউল করিম জীম।।
ময়মনসিংহ, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তনে হিট স্ট্রেস সমস্যা বর্তমানে আরও তীব্র হয়েছে। অথচ বেশিরভাগ খামারেই নেই কোনো আধুনিক ব্যবস্থা, যা আগে থেকে জানাবে 'পশুটি ঝুঁকিতে আছে'। ঠিক এমন আধুনিক ব্যবস্থার পরিকল্পনাকে বাস্তবতায় রূপ দিতে এক তরুণ গবেষক গড়েছেন নতুন সম্ভাবনার পথ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আল মোমেন প্রান্ত প্রযুক্তির হাত ধরে এই সংকটের সমাধান খুঁজে বের করেছেন। আর তাঁর গবেষণায় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রকিবুল ইসলাম খান। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ খামারে প্রযুক্তিটি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছেন পশুবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস.এম. আরিফুল ইসলাম। গবেষকদল উদ্ভাবন করেছেন একটি স্বয়ংক্রিয় 'সেন্সর-নির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক ফার্ম মনিটরিং ও হিট স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি'।
উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটির বিষয়ে প্রান্ত বলেন, এটি একটি স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রযুক্তি অর্থাৎ 'সেন্সর-নির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক ফার্ম মনিটরিং ও হিট স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি'। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে খামারে বসানো সেন্সর নির্দিষ্ট সময় পরপর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তথ্য সংগ্রহ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাউড প্ল্যাটফর্মে পাঠায়। তারপর তথ্যগুলো পৌঁছে যায় একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক বিশ্লেষক মডেলে। বিশ্লেষক মডেলটির কাজ হলো টেম্পারেচার-হিউমিডিটি-ইনডেক্স (টিএইচআই বা তাপমাত্রা-আর্দ্রতা সূচক) গণনা করা। টিএইচআই হল একটি সংখ্যা যা তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা উভয়কেই বিবেচনা করে পশুর শরীরে কেমন অনুভূত হচ্ছে তা জানান দেয়। এর মাধ্যমে মডেলটি 'নিরাপদ', 'সতর্ক', 'ঝুঁকিপূর্ণ' নাকি 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ'- এই চারটি ধাপে পশুর অবস্থা বোঝায়। পশুর অবস্থার ওপর ভিত্তি করে মডেলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফ্যান চালু বা বন্ধ করে। খামারিকে ফ্যান চালাতে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হয় না, এআই সিদ্ধান্ত নেয় কখন ফ্যান চালু হবে আর কখন বন্ধ হবে।
তিনি জানান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় পরিবেশের এসকল তথ্যকে বিশ্লেষণ করে পাওয়া সিদ্ধান্তগুলোর সারাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার ব্যবস্থা রয়েছে। ওয়েবসাইটে তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয় যাতে খামারি যেকোনো সময় দেখে নিতে পারেন তাদের পশু কোন স্তরে আছে এবং কখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই পুরো সিস্টেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে গবেষক প্রান্ত জানান, এটি প্রথমবার চালু করতে খরচ হয় মাত্র দুই হাজার ৫ শত টাকা। পরবর্তীতে ক্লাউড ও সার্ভিসিং খরচ বাবদ বছরে খরচ হবে ১ হাজার টাকা। একবার চালু করলে পরবর্তী সাত দিন কোনো মানব হস্তক্ষেপ ছাড়াই এটি চলবে। খামারি শুধু ওয়েবসাইটে পশুর অবস্থা দেখবেন আর সময় মতো পদক্ষেপ নেবেন। খামারিদের জন্য এটি হবে একটি স্বল্পব্যয়ী ও ব্যবহারবান্ধব সমাধান।
বিশ্বব্যাপী পশুর ওপর হিট স্ট্রেসের প্রভাব তুলে ধরে প্রন্ত বলেন, 'বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ২১ শতকের শেষে গবাদিপশুর হিট স্ট্রেসজনিত ক্ষতি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। আফ্রিকা ও আমেরিকার মতো অঞ্চলে বহু ডেইরি খামার হিট স্ট্রেসের কারণে দুধ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে এই সমস্যার কারণে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পূর্ব আফ্রিকার ২০ শতাংশ পশুপালন সংশ্লিষ্ট অঞ্চল এই সংকটে পড়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের ডেইরি শিল্পও ভবিষ্যতে বছরে দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
এই পটভূমিতে, এমন একটি স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম উদ্ভাবন শুধু সময়োপযোগী নয় বরং বৈশ্বিক পর্যায়েও দৃষ্টান্তমূলক বলে মনে করছেন প্রান্ত। বর্তমানে প্রযুক্তিটি মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত। শিগগিরই গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ জমা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
প্রযুক্তিটির সম্ভাবনা নিয়ে অধ্যাপক ড. রকিবুল ইসলাম খান বলেন, 'এই প্রযুক্তি শুধু একটি উদ্ভাবন নয়, এটি খামার ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে খামারিদের শ্রম কমবে, খরচ কমবে এবং যথাযথ ব্যবহারে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। তথ্য না জানা, অবহেলা বা দেরির কারণে পশুর শরীরে হিট স্ট্রেসজনিত যে জটিলতা তৈরি হয়, সেগুলো এ প্রযুক্তির মাধ্যমে আগেভাগেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। প্রযুক্তিটির কার্যকর ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী।'
তবে এখানেই থেমে নেই গবেষণা। গবেষণার ভবিষ্যৎ আরও বিস্তৃত বলে জানিয়েছেন গবেষক প্রান্ত। তিনি জানান, ভবিষ্যতে এতে যুক্ত হবে অ্যামোনিয়া, মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড সেন্সর। তখন পশুর শ্বাস-প্রশ্বাস ও পরিবেশগত গুণাগুণও বিশ্লেষণ করা যাবে। ধীরে ধীরে এটি রূপ নিতে পারে সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রিসিশন লাইভস্টক ফার্মিং সিস্টেমে। প্রান্ত চান, কোনো খামারি যেন আর অসহায় না থাকেন। গরমের কারণে গরুর রোগ কিংবা মৃত্যু নিয়ে খামারি যেন আর আক্ষেপ না করেন। তাঁরা আগে থেকে যেন গরুর অবস্থা জানতে পারেন আর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। সাশ্রয়ী প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে তিনি বদলে দিতে চান দেশের খামার চিত্র।