কক্সবাজার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন যুগের প্রবেশদ্বার হিসেবে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে।
একটি উচ্চাভিলাষী ৩০ বছর মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে, প্রবৃদ্ধি অর্জন ও কর্মসংস্থানের জন্য সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে একটি অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে সরকার মহেশখালী-মাতারবাড়ির উপকূলীয় অঞ্চলকে নীল অর্থনীতির একটি বৈশ্বিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
নবগঠিত সংস্থা মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (মিডা) এই রূপান্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
পরিকল্পনাটিতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর, সমন্বিত জ্বালানি সুবিধা, পরিবহন অবকাঠামো এবং শিল্প অঞ্চলের উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে - যা এই অঞ্চলটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি কৌশলগত সামুদ্রিক এবং জ্বালানি প্রবেশদ্বার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
মিডা’র তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পটি তিন দশক ধরে আনুমানিক ৬০-৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। এটি ২০৫৫ সালের মধ্যে জাতীয় জিডিপিতে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো অবদান রাখবে এবং প্রায় ২.৫ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পটি তিনটি পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে: ২০২৫-২০৩০, ২০৩০-২০৪৫ এবং ২০৪৫-২০৫৫। মাস্টার প্ল্যানের সাম্প্রতিক উপস্থাপনার সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এটি কেবল একটি বন্দর প্রকল্প বরং তার চেয়েও বেশি কিছু।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘সমুদ্র হবে বিশ্বের সাথে আমাদের মহাসড়ক। আমাদের এমন একটি শহর গড়ে তুলতে হবে যা একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত নীল অর্থনীতির নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে।’
এই উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, যা ২০২৬-২০২৭ সালের মধ্যে কার্যকর হওয়ার আশা করা হচ্ছে। নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নত সামুদ্রিক সুবিধা হয়ে উঠবে, যেখানে বৃহৎ আন্তর্জাতিক কন্টেইনার জাহাজ পরিচালনার সক্ষমতা থাকবে। আধুনিক মহাসড়কের মাধ্যমে বন্দরটি জাতীয় ও আঞ্চলিক বাজারের সাথে সংযুক্ত হবে।
ঈাশাপাশি, মহেশখালীকে একটি জাতীয় জ্বালানি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে এলএনজি, এলপিজি, তেল সংরক্ষণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ চলমান রয়েছে। সেখানে একটি ১,২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে, টেকসই লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য আরও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিকল্প অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
বৃহত্তর পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সমুদ্রবিদ্যা, সামুদ্রিক জৈবপ্রযুক্তি এবং টেকসই মৎস্য চাষের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
পরিবেশ-পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলা, উপকূলীয় সংরক্ষণ কর্মসূচি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে পরিবেশ সুরক্ষাকে একীভূত করে স্মার্ট নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনাও চলছে।
বিশেষজ্ঞরা এই অঞ্চলটিকে একটি সম্ভাব্য ‘নতুন চট্টগ্রাম’ হিসেবে দেখছেন এবং এমনকি এমন একটি শহর কল্পনা করেছেন যা সিঙ্গাপুর বা সাংহাইয়ের মতো আন্তর্জাতিক কেন্দ্রগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে এবং নেপাল ও ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির সাথে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠী আশাবাদ ব্যক্ত করেছে যে, "যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এই প্রকল্পটি আমাদের জীবন বদলে দিতে পারে।’ মহেশখালীর বাসিন্দা সৈয়দ নূর বলেন, ‘আমরা আশা করি এটি কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও উন্নত জীবনযাত্রা সুবিধা নিয়ে আসবে।’
মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ির জামাল মিয়া বলেন, এই প্রকল্প স্থানীয় জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পথ প্রশস্ত করবে। বর্তমানে এলাকায় কাজের সুযোগ খুবই সীমিত।
তিনি বলেন, ‘সেখানে শিল্প ও কারখানা স্থাপন করা হবে, যা দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতি ভিত্তিক প্রথম বৃহৎ উপকূলীয় নগর ও শিল্প প্রকল্প হিসেবে, মহেশখালী-মাতারবাড়ি উন্নয়ন সমুদ্রের সাথে দেশের সম্পর্ককে নতুনরূপে ভৌগোলিক সীমানার বাইরে সুযোগ সৃষ্টি করবে।