।। মো. সাজ্জাদ হোসেন ।।
ঢাকা, ২ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : কুমিল্লার দেবিদ্বারের উপজেলার বরকামতা গ্রামে প্রবেশ করলে যেন এক ভিন্ন আবহ ভেসে আসে। গ্রামীণ পথের নৈঃশব্দ ভেঙে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন স্থাপনা-বরকামতা দুর্গাবাড়ি। প্রায় ১৩ শতাব্দী ধরে এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের এক বিরল সমন্বয় এই পূজা, যা শুধু একটি ধর্মীয় আয়োজন নয়, বরং মানুষের ভক্তি, সাহস ও সামাজিক সংহতির প্রতীক হয়ে আছে আজও।
বাংলাদেশের অন্যান্য দুর্গাপূজার মতো এখানে বিসর্জন নেই। ১৯৬৬ সালের আশ্বিন মাসের নবমী তিথির ঘটনা স্থানীয় মানুষ আজও ভুলেনি। তাদের বিশ্বাস, সেদিন রাতে মা দুর্গা স্বপ্নযোগে ভক্তদের নির্দেশ দিয়েছিলেন-তাঁকে বিসর্জন দেওয়া যাবে না। সেই থেকে এখানে প্রতিমা স্থায়ীভাবে পূজিত হয়ে আসছে। বিসর্জনের পরিবর্তে শুরু হয় প্রহরব্যাপী নামযজ্ঞ। প্রথমে ৫৬ প্রহর, পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১২ প্রহরে। এখনো সেই প্রার্থনা ও নামসঙ্কীর্তনের ধারা অব্যাহত আছে, যা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামজুড়ে সৃষ্টি করে এক ভক্তিময় পরিবেশ।
বরকামতার ইতিহাস বহু প্রাচীন। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে সমতটের রাজধানী ছিল এ জনপদ। বৌদ্ধ নৃপতি দেব খড়গের মহিষী প্রভাবতী দুর্গাকে ‘শর্বাণী’ নামে পূজা করতেন। সেই থেকে এই পূজার সূচনা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে। গ্রামটির চারপাশে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের চিহ্ন-২৫ ফুট উঁচু ঢিবির উপর শিবলিঙ্গ, শুভপুরে বজ্রপাণি বোধিসত্ত্বের মূর্তি, পিহর গ্রামে মহাযানী দেবী মরীচির মূর্তি। এসব নিদর্শন প্রমাণ করে, বরকামতা ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ কেন্দ্র।
দুর্গাদেবী শক্তির প্রতীক। তাঁর ১০ হাতে ১০টি অস্ত্র মানব জীবনের সংগ্রাম, সৎকর্ম ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতীক। বরকামতার পূজা সেই প্রতীকের বাস্তব রূপ। এখানে দেবীর পূজা মানে শুধু আচার নয়-মানুষের হৃদয়ে মতো, সাহস ও ঐক্যের আলো জ্বালানো। পূজার দিনগুলোতে গ্রাম যেন হয়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত মিলনমেলা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এখানে এসে অংশ নেন আনন্দে, ভক্তিতে, সহযোগিতায়।
শুধু পূজা নয়, বরকামতা দুর্গাবাড়ি দীর্ঘদিন ধরে সমাজসেবার কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে। জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি, গণস্বাক্ষরতা, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বৃক্ষরোপণ, ত্রাণ বিতরণ-এসব কাজে এখানকার সদস্যরা নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নেন। পূজামণ্ডপ তাই ধর্মীয় আচার ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে সমাজকল্যাণ ও মানবসেবার কেন্দ্র বিন্দু।
এই পূজার ঐতিহ্য টিকে আছে বহু ধর্মপ্রাণ মানুষের অবদানে। যতীন্দ্র মোহন শীল, খগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, উপেন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণ দত্ত, দিলিপ দাশ, আবুল দত্ত-এরা নিজেদের শ্রম, অর্থ ও ভালোবাসা দিয়ে দুর্গাবাড়িকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ৭০ ও ৯০-এর দশকে নাটমন্দির, দুর্গামন্দির, রাধাগোবিন্দ ও কালীমন্দির পুনর্নির্মাণ হয় স্থানীয় উদ্যোগে। ফলে বরকামতা দুর্গাবাড়ি শুধু পূজার স্থান নয়, এটি হয়ে উঠেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঐতিহ্য বহনকারী এক অমূল্য সম্পদ।
বরকামতা দুর্গাবাড়ির সাধারণ সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘মা দুর্গার কাছে আমাদের প্রার্থনা হোক, তিনি যেন অশুভ শক্তির অবসান ঘটিয়ে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের আলোকে বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।’
বরকামতার দুর্গাপূজা তাই আজও বয়ে আনে এক অন্যরকম আবেগ। ভোরের শঙ্খধ্বনি, ঢাকের শব্দ, কীর্তনের সুর-সব মিলিয়ে সৃষ্টি করে এমন এক আবহ, যা অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ১৩ শতকের এই পূজা প্রমাণ করে, বিশ্বাস ও ঐতিহ্য কখনো হারিয়ে যায় না; বরং যুগ থেকে যুগান্তরে আলো ছড়ায়, মানুষকে একসূত্রে বাঁধে।