বেলাল রিজভী
মাদারীপুর, ৯ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রাম।
আর এই আউলিয়াপুর গ্রামেই ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজদের অত্যাচারের মধ্যে একটি অত্যাচারের গল্প রয়েছে নীল চাষীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও সেই অত্যাচারের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। জোর করে চাষীদের দিয়ে নীলচাষ করানো এবং চাষীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের জন্য নীলকুঠিতে ছিল আলাদা কক্ষ। মাদারীপুর সদর উপজেলায় এখনো টিকে আসে সেই দুঃসহ স্মৃতিবিজড়িত একটি নীলকুঠি। যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে নীলকুঠি ইংরেজ শোষনের এক ইতিহাস বহন করে আসছে।
শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কের ছিলারচর থেকে আউলিয়াপুর গ্রামের জন্য আলাদা একটি গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। ওই সড়ক দিয়ে একটু এগুলেই আউলিয়াপুর বাজার।
বাজারের সাথেই নীলকুঠির (নীল তৈরির কারখানা) ধ্বংসাবশেষ পরে আছে। তৎকালীন সময়ে ডানলপ নামের এক ইংরেজ এই নীলকুঠীর তত্ত্বাবধানে ছিল। এজন্য 'ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি' স্থানীয়দের কাছে 'ঢলক সাবের' নামে পরিচিত এই নীলকুঠিটি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, লম্বা আকৃতির ১২ কক্ষ বিশিষ্ট একটি কাঠামো (নীল তৈরির কারখানা)। যা নীল তৈরির হাউস (কংক্রিটের তৈরি পানি ধরে রাখার কৃত্রিম স্থান) নামে পরিচিত।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই হাউসের মধ্যে পানি দিয়ে নীল ভিজিয়ে রাখা হতো। পাশেই রয়েছে ৪০ ফিট উচু একটি চিমনি। ভেঙে যাওয়া চিমনির অবকাঠামোগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দেখা গেছে, চিমনী ঘিরে জঙ্গল তৈরি এবং পাশে রয়েছে ধ্বংসাবশেষ অবস্থায় নীল তৈরির কারখানা। চিমনির ঠিক উল্টোপাশে লম্বালম্বি ভাবে কক্ষের অবকাঠামোতে তৈরি রয়েছে ১২ টি পৃথক স্থান।
স্থনীয়রা জানান, আউলিয়াপুর গ্রামের ১২ একর জমির ওপর নীলকুঠি ছিল। যার কিছু অংশ এখন অবশিষ্ট রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইংরেজ শাসনামলে মাদারীপুরে নীলচাষের জন্য ‘নীলকুঠি’ নামের একটি খামার স্থাপন করে ইংরেজরা। চাষাবাদের জন্য উর্বরভূমি হওয়ায় জেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামে নীলকরদের আস্তানা গড়ে উঠে। ধারণা করা হয় ১৮০০ সালের পূর্বে আউলিয়াপুর গ্রামে নীল তৈরির এই খামারটি গড়ে তোলা হয়।
খামারের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ডানলপ নামের এক ইংরেজ। ১৮৪৭-৪৮ সালে নীল চাষ করে স্থানীয় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নীল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তারা।
তখনই নির্মম অত্যাচার-জুলুমের শিকার হন কৃষকেরা।
আউলিয়াপুর গ্রামে নীলকুঠিটি স্থাপন করেন ডানলপ। মাদারীপুর জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের আউলিয়াপুর গ্রাম সংলগ্ন ছিলারচর নদী তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নীল তৈরির খামার। তবে এখন যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা ইংরেজ শাসনামলে নীল চাষীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস বহন করে চলেছে।
স্থানীয়রা আরও জানান,'এই নীলকুঠি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। মাঝেমধ্যে স্কুলের ছাত্ররা আসে পিকনিক করতে। অনেক সময় বিদেশীদেরও দেখা যায় এখানে। গ্রামের বয়স্করা মনে করেন, এই নীলকুঠি অভিশপ্ত এক জায়গা! তবে নীলকুঠির যতটুকু এখন অবশিষ্ট রয়েছে তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। আর এই নীলকুঠির সাথেই রয়েছে খ্যাতিমান আউলিয়া হযরত শাহ সুফী খাজা ইউসুফ শাহ আহসানের দরগা শরীফ। অযত্ন-অবহেলায় এই দরগা শরীফটিও আজ জরাজীর্ণ।
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ইংরেজদের অত্যাচারে যখন অতিষ্ট এ অঞ্চলের কৃষকেরা, তখন ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরিয়তউল্লাহ (র.) এবং তার পুত্র পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া (র.) কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন।
এ সময় বৃহত্তর ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ফরায়েজী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
ইংরেজ ও জমিদারদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করাই ছিল নীল বিদ্রোহ হাজী শরীয়তউল্লাহ (র.) এর উদ্দেশ্য। পরিবর্তিতে হাজী শরিয়তউল্লাহ (র.) এর মৃত্যুর পর তার ছেলে পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া (র.) এর সাথে নীলকরদের যুদ্ধ হয়। তাদের প্রতিরোধের ফলেই এ এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় নীলকররা। স্বাধীন হয় নির্যাতন-নিপীড়নে শিকার এই অঞ্চলের কৃষক।
আউলিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মকবুল বলেন, ইংরেজ ঢলক সাব (ডানলপ) এই এলাকায় নীল চাষ করতো। আমার দাদার কাছে শুনেছি, এই এলাকায় ৭ টা কুঠি আছিল। আর এই কুঠিটাই সবচেয়ে বড় ছিল।
এই কুঠিতেই ঢলক সাব থাকতো। আমাদের গ্রামের পূর্ব পুরুষেরা অনেক অত্যাচার সহ্য করেছিল!
১৭৭৭ সালের দিকে ভারতীয় উপ-মহাদেশে প্রথম নীল চাষের আগমন ঘটে। উইকিপিডিয়া সূত্র অনুযায়ী, ১৭৭৭ সালের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে লুই বোননড নামে এক ফরাসি নাগরিকের মাধ্যমে নীলের চারা এ অঞ্চলে রোপন করা হয়। এরপর ১৮৩০ সালের মধ্যে সারা বাংলায় ১ হাজারেরও বেশি নীল তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়।
নীলকরেরা কৃষকদের নিজস্ব জমিতে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নীল চাষ করতে বাধ্য করেছিলেন।
বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় ডানলপ সাহেবের নীলকুঠির পূর্ব দিকে রণখোলা, পশ্চিমে আউলিয়াপুর বাজার, উত্তরে কালীতলা ও দক্ষিণে আউলিয়াপুর দরগা শরীফ। রণখোলা নামক স্থানেই নীলকরদের সাথে যুদ্ধ হলে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায় এই এলাকার নীলকর ও তার লোকজন। মুক্তি পায় কৃষকেরা।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব জানান, স্থানটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটি ইতিহাসের একটি স্মারক।