মৎস্য অভয়ারণ্যে নতুন মোড়কে পুরনো দস্যুতার অবসান চান জেলেরা

বাসস
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ২০:৩২ আপডেট: : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ২০:৩৫
ছবি : বাসস

আল-আমিন শাহরিয়ার

ভোলা, ১০ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার উপকূলের মৎস্য অভয়ারণ্যসহ বিভিন্ন উপজেলার নদী ও সাগর মোহনার মৎস্য আড়ৎ, মাছঘাট এবং অবতরণ কেন্দ্রগুলোতে নতুন মোড়কে পুরনো দস্যুতা ক্রমেই ভয়াবহ রুপ ধারণ করছে। ইলিশের অভয়ারণ্যখ্যাত উপকূলীয় জেলার সাগর আর নদ-নদীতে 'মা' ইলিশ ধরায় রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মানতে চাইছেনা ওয়াটার লর্ডরা। এরা বিগত ১৭ বছরের স্বৈর-শাসনামলের শোষণ নিপীড়নের বলয় থেকে এখনো বেরুতে চাচ্ছেনা। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত ফ্যাসিস্ট জমানার পুরোটাতেই ভোলাসহ পুরো উপকূলীয় জেলার মৎস্য অভয়ারণ্যে ক্ষমতাসীনদলের দস্যু বাহিনী কোনোপ্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইলিশ'সহ সবধরনের মাছ লুটের মহোৎসব চালাতো। 'মা' ইলিশ ধরতে কাগজে-কলমে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেই নিয়মের ছিটেফোঁটাও মানা হতোনা এতদাঞ্চলে। 

তথ্য অনুযায়ী, জুলাই বিপ্লবের পর ভোলার সাত উপজেলায় ফ্যাসিস্ট জমানার গডফাদারদের কেউ কেউ গ্রেফতার কিম্বা পালিয়ে থাকলেও নদী লুটের সাথে জড়িতরা কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। আইনের ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে দস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। 

সেই ধারাবাহিকতায় এখনো ওই চক্রটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে তারা শক্তিশালী ইঞ্জিনচালিত ফিশিংবোট হাকিয়ে শুধু নদীতেই নয়, বঙ্গপোসাগরের বিশাল জলরাশিতেও মাছের ওপর লুটের খড়গ বসায়। 

অতীতকালের নিয়মের আলোকে দস্যুদলের মাছ লুটের এমন প্রস্তুতিকে গতকাল বৃহস্পতিবার গুড়িয়ে দিলো উপকূলে দায়িত্বরত নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের জোয়ানরা। 

ভোলার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বাসস'কে এমন তথ্যই দিয়েছেন। তিনি জানান, ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে 'মা' ইলিশ রক্ষায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টাব্যাপী মনপুরা উপজেলার জনতা বাজার, পূর্ব তালতলী ও লতাখালী ঘাট এলাকায় যৌথবাহিনী অভিযান পরিচালনা করে। এসময় ৪৫টি সামুদ্রিক মাছ ধরার ট্রলার বরফ বোঝাই অবস্থায় জব্দ করা হয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব ট্রলারে বরফ সংরক্ষণ করে অসাধু চক্র গোপনে 'মা' ইলিশ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মৎস্য দপ্তর আরও জানায়, এসব বরফের মূল্য প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টাকা হবে। 

মনপুরার জেলে ও আড়ৎদাররা জানান, সেখানকার আ'লীগ আমলের দূর্বৃত্তরা এখনো নদী ও সাগরে নির্ভয়ে 'মা' ইলিশ ধ্বংসে লিপ্ত রয়েছে। বরফ বোঝাই আটককৃত এসব ফিশিংবোটগুলো ওইসব অসাধু চক্রের মালিকানাধীন বলে জানান তারা। 

সরেজমিনে ভোলার নদী ও সাগর মোহনার মৎস্য আড়ৎ, মাছঘাট ও অবতরন কেন্দ্রগুলোতে গেলে মৎস্যপেশায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা মাছ লুটের চাঞ্চল্যকর বহু তথ্য তুলে ধরেন। 

জেলার সর্বদক্ষিণের জনপদ চরফ্যাশনের সামরাজ মৎস্য অবতরন কেন্দ্রে গেলে সেখানকার জেলেসহ অনেকে জানান, ওই আসনের সাবেক সাংসদ আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের ভাই সৌরভের মালিকানাধীন শতাধিক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ফিশিং ট্রলিং বোট রয়েছে। সেগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য অভয়ারণ্যে মৌসুমে শত শত কোটি টাকার ইলিশ আহরণ হতো। বিশেষ করে 'মা' ইলিশ ও জাটকা নিধনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে হাতিয়ার বানিয়ে সৌরভ বাহিনী সাগর ও নদীতে ইলিশ লুটের উৎসব চালাতো। সরকারের পটপরিবর্তনের পর লর্ডখ্যাত সৌরভ গা ঢাকা দিলেও তার দস্যু বাহিনী এখনো স্বরব রয়েছে। 

সেখানকার সাবেক সাংসদ জ্যাকবের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত স্থানীয় চর কুকরী-মুকরী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজনের বিরুদ্ধেও সাগর নদীতে ইলিশ লুটের অভিযোগের অন্ত: নেই। জুলাই বিপ্লবের পর এই লুটেরাখ্যাত চেয়ারম্যান পালিয়ে বেড়ালেও তার গৃহপালিত জলদস্যুর দল এখনও সাগর-নদীর জলাশয় নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বলে জেলেরা অভিযোগ করেছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই উপজেলা আ'লীগের সাধারণ সম্পাদক দ্বীপক চৌধুরীর নেতৃত্বে সেখানে রয়েছে-জলদস্যুদলের একাধিক গোপন আস্তানা। এসমস্ত জলদস্যুরা মনপুরা থেকে দ্বীপক চৌধুরী'র ফিশিং ট্রলার নিয়ে এখনো সাগর-নদী দাবিয়ে বেড়ায়। একই অবস্থা জেলা সদর ভোলার নদ-নদীতেও। 

মৎস্য সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে,এখানে বিগত স্বৈরজমানায় জেলা আ'লীগ'র যুগ্ম সম্পাদক দোর্দন্ড প্রতাপশালী জহুরুল ইসলাম নকীবের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল সাগর নদীর মৎস্যজীবীদের ওপর। তার মালিকানাধীন ফিশিংবোটগুলো সরকারের নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে পুলিশের বিপদগামী কিছু সদস্যকে নিয়েই নদীতে 'মা' ইলিশ লুটের কাজে নিয়োজিত থাকতো। 

ভোলার মৎস্য পেশার সাথে জড়িতদের দেয়া তথ্যানুযায়ী জেলায় বিগত স্বৈরশাসনকালের প্রভাবশালী ওয়াটারলর্ডদের মালিকানাধীন কমপক্ষে দশ সহস্রাধিক ফিশিং ট্রলার রয়েছে। কালের বিবর্তনে এসমস্ত লর্ডরা উপকূলের মৎস্য অভয়ারণ্যে লুটের রাজত্ব চালাচ্ছে। 

ভোলার মৎস্যজীবী ও বিজ্ঞ মহল মনে করছেন, ইলিশখেকো এসব দস্যু বাহিনীকে এখনই প্রতিহত করা না গেলে এরা পুরো নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে রাষ্ট্রের মৎস্য সম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকির কারন হতে পারে।

ভোলার পুলিশ সুপার মো.শরীফুল হক গণমাধ্যমকে জানান, ভোলার নদী ও সাগরকুলের মৎস্য অভয়ারণ্যকে নিরাপদ রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বদা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় রয়েছেন। এখনানকার জলরাশি ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন জিরো টলারেন্স বলেও জানিয়েছেন, জেলা পুলিশের এ শীর্ষকর্তা। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের মৃত্যুতে ঢাবি সাদা দলের শোক
নিউজিল্যান্ডের কাছে বড় হার বাংলাদেশের
হেফাজতে ইসলাম সবার জন্য পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করছেন : এ্যানি
সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের বেহাল অবস্থা অবসানের দাবি আরিফুল হক চৌধুরীর
বিএনপি কোনো অবস্থাতেই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে বিশ্বাসী নয় : ডা. জাহিদ হোসেন
কঠিন চীবর দানোৎসবের মাধ্যমে সম্প্রীতির মেলবন্ধন সুদৃঢ় হবে : পার্বত্য উপদেষ্টা
নোবেল পুরস্কারে ট্রাম্পের বাদ পড়া ‘শান্তিকে ছাড়িয়ে রাজনীতি’ ছিল’: হোয়াইট হাউস 
দেশবাসীর মুক্তির জন্য ট্রাম্পই একমাত্র ভরসা: নোবেল জয়ী মাচাদো
শনিবার ভোরে দেশে ফিরছেন শহিদুল আলম
পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা
১০