
।। মুহম্মদ নূরুজ্জামান।।
খুলনা, ১ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দেখে মনে হতেই পারে বিশেষ কোনো অতিথি। সব আয়োজনও ঠিক তেমন। হাতে লাল গোলাপ ও রজনিগন্ধার স্টিক। স্বাগত জানাতে অপেক্ষায় বড়ো কর্তারা। আছে ক্যামেরা ও বিভিন্ন চ্যানেলের বুম হাতে গণমাধ্যমকর্মীরা। রয়েছে আথিতিয়তাও। তবে যাদের জন্য এত এত আয়োজন, তারা সাধারণ কোনো অতিথি নন। তাদের পরিচয় কয়েদি। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এই আসামি বন্দিদের নতুন কারাগারে স্থানান্তর করতেই করা হয় এত সব আয়োজন।
আর এর মধ্য দিয়েই খুলনার কারা ইতিহাসে যুক্ত হলো নতুন ফাইল ফলক। দেশের আধুনিক কারাগারটির যাত্রা হলো আজ। ৪০০০ কয়েদি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কারাগারটি আসলে একটি সংশোধনাগারের আদলে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে পৃথক পৃথক ব্যারাকে সব ধরনের বন্দিদের রাখার ব্যবস্থা আছে। ১১৩ বছরের পুরাতন কারাগার ছেড়ে ১০০ বন্দি আজ পেলেন নতুন ঠিকানা।
খুলনা জেলা কারাগারের সুপার মো. নাসির উদ্দিন প্রধান বাসসকে বলেন, খুলনার পুরাতন কারাগার থেকে নতুন এই কারাগারের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। আজ শনিবার (১ নভেম্বর) বেলা ১১টায় তিনটি প্রিজন ভ্যানে করে ১০০ জন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকে (পুরুষ) খুলনার নতুন আধুনিক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় সদর দপ্তরের কারা উপ-মহাপরিদর্শক মনির আহমেদ নতুন কারাগারে লাল গোলাপ ও রজনিগন্ধা ফুল দিয়ে বন্দিদের বরণ করেন। খুলনার জেল সুপার নাসির উদ্দিন প্রধান, জেলার মুনীর হোসাইনসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
খুলনা জেলা কারাগারের সুপার মো. নাসির উদ্দিন প্রধান বলেন, ইতোমধ্যেই নতুন কারাগারে ৮৩ জন কারারক্ষী এবং একজন ডেপুটি জেলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন কোনো সুপার এবং জেলার নিয়োগ না হওয়ায় পুরাতন কারাগারের সুপার এবং জেলার দুটি কারাগারেই দায়িত্ব পালন করবেন।
সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে বন্দিদের নতুন ঠিকানায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল গত শনিবার (২৫ অক্টোবর)। কিন্তু খুলনার নতুন জেলা কারাগার নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় এ কার্যক্রম এক সপ্তাহ পিছিয়ে যায়। এরই মধ্যে মাটি ভরাটের কিছু কাজ হলেও পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি।

খুলনা জেলা কারাগারের জেলার মুনীর হোসাইন বলেন, আজ নতুন কারাগারে ১০০ জন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে স্থানান্তর করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো বন্দি সেখানে নেওয়া হবে। এছাড়া যশোর জেল থেকেও কিছু সাজাপ্রাপ্ত বন্দী নতুন কারাগারে আনা হবে। ফলে খুলনা ও যশোরের কারাগার কিছুটা চাপমুক্ত হবে।
তিনি জানান, খুলনার অত্যাধুনিক এই কারাগারটিতে আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। কারাগারটি সংশোধনাগার হিসেবেই গণ্য হবে। এখানে কয়েদিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মজীবী করে গড়ে তোলা হবে। যাতে সাজা শেষে বাইরে গিয়ে তারা কিছু করতে পারেন। এ ছাড়া তাদের অপরাধজগৎ থেকে ফিরিয়ে আনতে তাদের কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা হবে।
কারা সূত্র জানায়, নতুন কারাগারের কার্যক্রম শুরু হলেও পুরাতন (বর্তমান) কারাগারটিও চালু থাকবে। ভবিষ্যতে নতুন কারাগারটি জেলার কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া বর্তমান জেলখানা ঘাট এলাকায় থাকা কারাগারটি মেট্রোপলিটন কারাগার হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, খুলনায় দুটি কারাগার চলমান রাখার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুব শীঘ্রই এটি গেজেট হিসেবে প্রকাশ করা হলে পৃথক নামে দুটি কারাগারে পৃথকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। কার্যক্রম শুরু হলে দুই কারাগারে জেল সুপার ও জেলার আলাদা আলাদাভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বর্তমান কর্মকর্তারাই দুটি কারাগারের দায়িত্ব পালন করবেন।
জেলা কারাগারের জেলার মুনীর হোসাইন বলেন, খুলনায় দুটি কারাগারেই বন্দি রাখা হবে। ভবিষ্যতে পুরাতন (বর্তমান) কারাগারটি মেট্রোপলিটন কারাগার হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং এখানে খুলনা সিটি করপোরেশন বা মেট্রোপলিটন থানা এলাকার বন্দিদের রাখা হবে। এছাড়া নতুন কারাগারে খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলার বন্দিদেরও রাখা হবে।
কারাগার কর্তৃপক্ষ জানায়, ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত বর্তমান কারাগারটি ১৯১২ সালে নির্মিত। ১১৩ বছরের পুরোনো খুলনা কারাগারে বন্দির ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৬৭৮ জন। সেখানে বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দি অবস্থান করছেন। এছাড়া জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হচ্ছে বন্দিদের। ফলে সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নতুন কারাগার চালু হওয়ায় স্থান সংকট অনেকটাই দূর হবে বলে আশা করছেন কারা কর্তৃপক্ষ।
নগরীর ভৈরব নদের তীরে খুলনা সিটি বাইপাস সড়কের জিরো পয়েন্টের অদূরে প্রায় ৩০ একর জমির ওপর গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে নতুন কারাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এতে পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ হাজার বন্দি থাকতে পারবেন। তবে আপাতত ২ হাজার বন্দি রাখার অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। পরে প্রয়োজন পড়লে পৃথক প্রকল্প নিয়ে অন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।
এই নতুন কারাগার নির্মাণের প্রকল্প ২০১১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন করা হয়। ব্যয় ধরা হয় ১৪৪ কোটি টাকা। স্থান নির্ধারণ, জমি অধিগ্রহণসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জুনে। এরপর ২০১৭ সালে প্রকল্প সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫১ কোটি টাকা এবং কাজ শেষের লক্ষ্য নেওয়া হয় ২০১৯ সালের ৩০ জুন। কিন্তু তা আর হয়নি। ২০২৩ সালে ফের প্রকল্প সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে হয় ২৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সময় বাড়ানো হয় মোট আটবার।
প্রকল্প অফিস থেকে জানায়, নতুন এ কারাগার নির্মাণ হয়েছে সংশোধনাগার হিসেবে। এখানে বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের পৃথক স্থানে রাখা হবে। কিশোর ও কিশোরী বন্দিদের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যারাক। নারীদের জন্য রয়েছে পৃথক হাসপাতাল, মোটিভেশন সেন্টার ও ওয়ার্ক শেড। একইভাবে বন্দিদের জন্য ৫০ শয্যার হাসপাতাল, কারারক্ষীদের সন্তানদের জন্য স্কুল, গ্রন্থাগার, খাবার কক্ষ, আধুনিক সেলুন ও লন্ড্রি রাখা হয়েছে। কারাগারে শিশু সন্তানসহ নারী বন্দিদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড ও ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। এ ওয়ার্ডে সাধারণ নারী বন্দি থাকতে পারবেন না। সেখানে শিশুদের জন্য লেখাপড়া, খেলাধুলা, বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা থাকবে। কারাগারে পুরুষ ও নারী বন্দিদের হস্তশিল্পের কাজের জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্ক শেড, বিনোদনকেন্দ্র ও নামাজের ঘরও রয়েছে।
কারা সূত্র জানায়, বন্দিদের প্রতিটি ব্যারাকের চারপাশে পৃথক সীমানা প্রাচীর রয়েছে। এক শ্রেণির বন্দিদের অন্য শ্রেণির বন্দিদের সঙ্গে মেশার সুযোগ নেই। ভেতরে শুধু প্রাচীরই রয়েছে প্রায় ৫ কিলোমিটার। এছাড়া ড্রেন, ফুটপাত, পয়োবর্জ্য শোধন কেন্দ্র, ওয়াকওয়ে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা, দুটি পুকুর ও সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে মাটি ভরাটসহ বেশ কিছু কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে।