
মুহাম্মদ নুরুজ্জামান
খুলনা, ২৩ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস): দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত খুলনায় এবারও শীতকালীন সবজির ব্যাপক ফলন হয়েছে। যার বাজার মূল্য আনুমানিক ২ কোটি ৮৫ লাখ ৮৮৩ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্র জানায়, উন্নত বীজ উৎপাদন, উদ্ভাবনী চাষাবাদ কৌশল এবং অনুকূল আবহাওয়া শীতকালীন সবজি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ডুমুরিয়ায় উৎপাদিত সবজি এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, অনুকূল জলবায়ু, উন্নতমানের বীজ, সার এবং কৃষি উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি ডিএই, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে চমৎকার ফলন সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও, কৃষি ব্যাংক এবং এনজিওসহ ব্যাংকগুলি বৃহৎ পরিসরে শীতকালীন সবজি চাষ কর্মসূচির সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ করেছে।
কর্মকর্তারা জানান, ডুমুরিয়া উপজেলার কীটনাশকমুক্ত ও নিরাপদ সবজি এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। যা স্থানীয় কৃষকদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। সবজি চাষিরা তাদের কষ্টার্জিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে দেখে গর্বিত। উৎপাদনের পাশাপাশি খুলনা অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল ও সুসংগঠিত সবজি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
সূত্র মতে, সারাবছরই সবজি চাষ করা হলেও শীতকালে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সবজি চাষ হয়। খুলনা ডিএই জোন (খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং নড়াইল জেলা) থেকে বিদেশি বাজারে নিরাপদ, কীটনাশকমুক্ত সবজির রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা স্থানীয় চাষীদের আরও উৎসাহিত করছে।
স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভালো দাম তাদের শীতকালীন সবজি চাষ, বিশেষ করে উচ্চ লাভের জন্য আগাম জাতের চাষ সম্প্রসারণে উৎসাহিত করেছে। এই মৌসুমে আবহাওয়া এবং বাজার উভয়ই অনুকূল থাকায় কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
জেলার বিস্তীর্ণ ক্ষেতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সারি সারি লাউ, কচুরিপানা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, মরিচ, লাল আমড়া, মূলা, শাকসবজি, পালং শাক এবং অন্যান্য শীতকালীন ফসল। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষকরা সেচ, আগাছা পরিষ্কার, স্প্রে এবং ফসল ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত থাকেন।
মৌসুমে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের মাধ্যমে হাজার হাজার চাষি ইতোমধ্যেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত এবং জাতীয়ভাবে স্বীকৃত সবজি চাষি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আবু হানিফ মোড়ল বাসসকে বলেন, বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এই বছর উৎপাদন চমৎকার হয়েছে। ফুলকপি, ওলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শিম, বেগুন, লাল আমড়া- সবকিছুরই ভালো ফলন হয়েছে এবং দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার গোলনা গ্রামের কৃষক মফিজ মিয়া বলেন, ‘ছয় বিঘা জমিতে শিম, টমেটো এবং ওলকপি চাষ করেছি। ফলন এবং দাম উভয়ই সন্তোষজনক। ডুমুরিয়ায় উৎপাদিত সবজি এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
এজন্য আমরা গর্বিত।’
উপজেলার খর্ণিয়া ইউনিয়নের বামুন্ডিয়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম বলেন, ‘কৃষি বিভাগ নিয়মিতভাবে কৃষকদের সার, বীজ, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছে। ফলস্বরূপ, বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। বিষমুক্ত সবজি এখন রপ্তানি হচ্ছে। ডুমুরিয়া দেশের জন্য একটি মডেল হয়ে উঠেছে।’
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কৃষক মহিউদ্দিন মল্লিক বলেন, ‘শীতের সবজির ব্যাপক ফলন হওয়ায় এবং দাম সন্তোষজনক হওয়ায় আমরা খুবই খুশি।’
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাজী রফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, ‘শীতকালীন সবজি কাটা প্রায় শেষের দিকে। আমরা ইতোমধ্যেই ঢাকা এবং অন্যান্য জেলার বিভিন্ন কাঁচাবাজারে এটি বিক্রি করছি। কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন এবং লাভ করছেন। এতে আমরা খুবই খুশি।’
ডিএই খুলনা জোন সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে খুলনায় ৩০ হাজার ৩৬৫ হেক্টর জমিতে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৭০৭ টনেরও বেশি শীতকালীন সবজি উৎপাদন হয়েছে। যা প্রতি হেক্টর জমিতে ২৩.৫৪ টন।
এই সূত্র আরও জানায়, খুলনা জেলায় ৮ হাজার ৩৩৫ হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ ৬ হাজার ২২২ টন শীতকালীন সবজির ফলন হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ২১.১৪ টন ফসল। বাগেরহাটে ৯ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৫১ হাজার ২৫২ টন ফসল, প্রতি হেক্টরে ২৭.৩১ টন ফসল। সাতক্ষীরায় ৯ হাজার ৬৯০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১৩ হাজার ১৮০ টন ফসল, প্রতি হেক্টরে ২২.০ টন ফসল। নড়াইলে ৭৪ হাজার ০৭৩ টন ফসল, প্রতি হেক্টরে ২৩.৫৯ টন ফসল। ২০২৫-২৬ মৌসুমের জন্য ডিএই ৩০ হাজার ১১ হেক্টর জমি থেকে ৭ লাখ ২৯ হাজার ৩০৫ টন শাকসবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যার গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ২৩.৫৮ টন।
কৃষি বিভাগ খুলনা জোনের অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, চলতি মৌসুমে খুলনা কৃষি অঞ্চলে শীতকালীন সবজি উৎপাদনের মূল্য প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। এতে গড়ে প্রতি কেজি সবজির দাম ৪০ টাকা। খুলনার সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ইতালি, ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়ায়ও রপ্তানি করা হয়। এবার ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে।
তিনি বলেন, ডিএই-এর পক্ষ থেকে আমরা মাঝে-মধ্যে দরিদ্র কৃষকদের সার, বীজ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করি।
দুই-তৃতীয়াংশ সবজি সংগ্রহ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকিগুলো ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হবে।