
মোফাজ্জেল হোসাইন
বরিশাল, ২৪ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : মাহিন্দ্রা গাড়ি চালিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বিকাশ মিস্ত্রী। স্থানীয় মাহিন্দ্রা গাড়ি চালানোর সুবাদে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে কৃষি কাজে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। সংসারের টানাপোড়েনের একপর্যায় বিকাশ মিস্ত্রী কিছু একটা করার ভাবনা থেকে শুরু করেন লতিরাজ বারি কচু-১ চাষ। প্রথমে তিনি ৫০ শতক জমিতে লতি চাষ করেন। আর এ কচুর লতি চাষ করেই ভাগ্য বদলেছেন বরিশালের বিকাশ। পাল্টে গেছে তার জীবন। আর ফিরতে হয়নি তার গাড়ির চাকা ঘুরাতে। বর্তমানে তিনি প্রায় ২ একর জমিতে চাষ করছেন কচুর লতি। বিকাশের ভালো আয় দেখে লতি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন স্থানীয়রাও।
বিকাশ মিস্ত্রী বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বায়েলাখালী গ্রামের বাসিন্দা। গত ৩ বছরে তার কৃষির প্রতি আগ্রহ বাড়ায় কচুর লতির পাশাপাশি এখন চাষ করছেন, পেঁপে, লাউ, ধুন্দল, বরবটিসহ বিভিন্ন সবজি। বাৎসরিক আয়ে এখন তার পরিবার স্বাবলম্বী। ভালো মুনাফা হওয়ায় প্রতিনিয়তই তিনি স্বপ্ন দেখছেন বৃহৎ আকারে একটি কৃষি খামার গড়ে তোলার।

সরেজমিনে জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বায়েলাখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিকাশ মিস্ত্রী তার কচু ক্ষেত পরিচর্যা করছেন। এসময় বিকাশের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, কৃষি কাজের প্রথম দিকে অনেকটাই হতাশা আর নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে এখন এই কাজে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এখন দিন দিনই কৃষি কাজের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিকাশ জানান, কৃষি কাজে আসলে যারা আসেন, প্রথমে তাদের অনেকেই লোকসানের সম্মুখীন হন এবং সঠিক পরামর্শ কিংবা কৃষি বিভাগের সাথে যোগাযোগ না থাকায় হয়রানিরও শিকার হয়ে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, একজন নতুন কৃষি উদ্যোক্তাকে অবশ্যই কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগীতা নিয়ে এ পেশায় আসতে হবে। আমার দেখা মতে, কাঠখড় পুড়িয়ে যখন একজন কৃষক খামার কিংবা ভালো ফসল উৎপাদন করে সফল হন, তখনই তিনি সবার চোখে পড়েন এবং অনেকেই ক্রেডিট নিতে চায়।
বিকাশ বলেন, এখন পর্যন্ত আমার নিজের চেষ্টায় এই পর্যন্ত এসেছি। তাছাড়া বাবুগঞ্জে আমার আশে পাশের অনেক কৃষক আছেন, যারা এখন পেঁপেসহ নানাধরণের সবজি আবাদ করছেন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আমাদের মত কৃষি উদ্যোক্তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এগিয়ে এলে আমরা ধান, পাট, পেঁপেসহ সব ধরণের সবজি উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবারাহ করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
জানা যায়, ববুগঞ্জ এলাকায় এই প্রথম বড় পরিসরে বিকাশের এই উন্নত দেশীয় জাতের লতিরাজ বারি কচু-১ চাষাবাদ দেখে স্থানীয়রা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। প্রতিদিনই চারা এবং নানা পরামর্শ নিতে তার কৃষি খামারে আসছেন নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তারা।

পাশের গ্রাম থেকে আসা সাইদুল মল্লিক বলেন, দেখলাম পরিত্যাক্ত জমিতেও লতিরাজ কচুর ভালো ফলন হয়। বিকাশের চাষাবাদ দেখে তার কাছে চারার অর্ডার দিয়েছি, আগামী মৌসুমে আমিও চাষ করব। তাছাড়া এই কচুর লতি চাষ বাবুগঞ্জে তেমন একটা নেই বললেই চলে। বিকাশ দার কচুর ক্ষেত দেখে আমিও লতিরাজ কচু চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে কচুর লতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর এর ফলনও ভালো, বছরের ৮ মাস একটা গাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ কেজি লতি হারভেস্ট করা যায়। এই লতি খেতেও মিষ্টি, যার কারণে বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া এই কচুর লতি উৎপাদন শেষ হলে কচুটিও আবার বাজারে ভালো দামে বিক্রি করা যায়।
বিকাশের খামারে কাজ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এলাকার অনেক যুব সমাজের। তেমনই একজন ভুব্রত বৈরাগী। তিনি বিকাশের খামারে নিয়মিত কাজ করে যে উপার্জন করছেন তা দিয়েই তার পরিবার চলে যাচ্ছে।
বিকাশের খামারের পাশাপাশি ছোট পরিসরে নানা ধরনের সবজির আবাদ করছেন সুজন নামে আরেক কৃষক। তিনি বলেন, জমিতে লতিরাজ বারি কচু চাষের পর তেমন একটা পরিচর্যা লাগে না। শুধু আগাছা পরিস্কার করা আর নিয়মিত পানি দিলেই হয়ে যায়। অন্যান্য কচু থেকে লতিরাজ বারি কচু অধিক উৎপাদন হয়।
বিকাশের পেঁপে বাগানে গাছ গাছে ঝুলছে শাহী জাতের পেঁপে। এবছর বিকাশ ৫০ শতাংশ জমিতে পেঁপের চাষ করেছেন। প্রায় ২৫০টি গাছে কাঁচা-পাকা মিলিয়ে ভালো একটা মুনাফা অর্জন করেছেন এবং এখনও গাছে যে পরিমাণ ফল রয়েছে তা থেকেও ভালো আয় হবে তার। এছাড়া মৌসুম বুঝে নানা সবজি চাষাবাদে বছরে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় করছেন বিকাশ মিস্ত্রী।

বিকাশের মত অনেক উদ্যোক্তারাই এখন কৃষি কাজে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এইসব প্রান্তিক কৃষকেরা।
এ বিষয়ে বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোসাম্মাত মরিয়ম জানান, প্রান্তিক কৃষকদের সকল ধরনের সহায়তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দিয়ে থাকে।
নতুন এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করে তুলছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বর্তমানে পেঁপেসহ কচুর লতি চাষাবাদে বরিশাল অঞ্চলের অনেক কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং এরইমধ্যে কয়েকজন সফলও হয়েছেন। এসব কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শসহ সহায়তা করে পাশে থেকে তাদের উদ্যোগকে তরান্বিত করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলে জানান তিনি।