//মহিউদ্দিন সুমন//
টাঙ্গাইল, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। ছোট বড় সকলের কাছে পরিচিত লাল ও সাদা বর্ণের এ ফুল। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব ও মানবসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতায় বিলুপ্ত হচ্ছে মুক্ত জলাশয়। এতে করে হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ফুল শাপলা। শাপলা ফুলের সেই সমারোহ এখন আর চোখে পড়ে না। দিনে দিনে শাপলা-শালুক যেন একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
টাঙ্গাইলে এক সময় নদী-নালা, খাল-বিলে শাপলা ফুলের সমারোহ ছিল। বর্ষা থেকে শরতের শেষ পর্যন্ত জলাভূমি ভরে যেত শাপলা ও ঢ্যাপের ফলনে। বর্তমানে অতিরিক্ত পুকুর খনন, কৃষিজমিতে স্থাপনা, কীটনাশক ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, সরকার এখনো শাপলা রক্ষার পদক্ষেপ নিলে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তা না হলে আগামী প্রজন্ম কেবল শাপলা বইয়ের পাতায় ছবি হিসেবে দেখবে।
জানা যায়, আজ থেকে ১৫ বছর আগেও টাঙ্গাইলে খাল-বিল, ঝিল ও বড় বড় দিঘির বুকে শাপলা ফুলের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এখন আর সেই দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য চোখে পড়ে না।
শাপলা গাছের গোড়ায় একাধিক গুটির জন্ম হয় যা ধীরে ধীরে বড় হয়ে শালুকে পরিণত হয়। একেকটি শালুকের ওজন সাধারণত ৫০ থেকে ৭০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঢ্যাপ মূলত শাপলার বীজ। এটা গ্রামীণ জীবনে ছিল এক বড় খাদ্য ও ওষুধের উৎসও। শাপলার ডাঁটা দিয়ে রান্না করা তরকারি ছিল গ্রামীণ মানুষের নিয়মিত খাদ্য। আর ‘ঢ্যাপ’ খাওয়ারও ছিল বহুমুখী ব্যবহার। গ্রামে প্রচলিত বিশ্বাস, এটি আমাশয়, বদহজম ও রক্ত আমাশয়ের ওষুধ হিসেবে কার্যকর। সচরাচর শালুক আগের মতো এখন আর দেখা যায় না। হাটে-বাজারে যা পাওয়া যায় তার দামও আকাশ ছোঁয়া। এক সময় টাঙ্গাইলের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে ঢ্যাপ সহজেই বিক্রি হতে দেখা যেত। এখন তা দুর্লভ হয়ে উঠেছে। ঢ্যাপের ভেতরে থাকে অসংখ্য ছোট ছোট বীজদানা। সেগুলো রোদে শুকিয়ে চাল তৈরি করা হয়। এই চাল দিয়ে দুর্গাপূজার সময় সনাতন ধর্মের গ্রাম বাংলার নারীরা বানাতেন খই ও নাড়ু। ঢ্যাপের খই ছিল শিশু ও বয়স্ক সবার পছন্দের খাবার। কৃষক পরিবারের অভাবের সময়ে ঢ্যাপ ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভরসা। সেটা এখন শুধুই স্মৃতিই বলা চলে।
সরেজমিনে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার চারান বিল ঘুরে দেখা গেছে, এই বিলে প্রতি বছর বর্ষার এই সময়ে বেশ শাপলা জন্মায়। এ বছর বন্যার পানি না আসার কারণে পর্যাপ্ত শাপলা হয়নি। যা কিছু হয়েছিল সেগুলো কৃষকরা তুলে নিয়ে গেছে বলে জানালেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, গত ১৫ বছর আগেও এই বিলে প্রচুর পরিমাণ শাপলা হতো। শাপলা দেখতে বিকেল বেলা বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা ঘুরতে আসতো। বন্যার পানি না আসার কারণে এই দিনে আগের মত শাপলা হয় না। যা হয় তা কৃষকরা তুলে হাটবাজারে বিক্রি করেন। এখন শুধু নৌকা দিয়ে ঘুরতে আসেন দর্শনার্থীরা।
ঘুরতে আসা ব্যবসায়ী সহিদুল ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি শাপলার ঢ্যাপ দিয়ে ভাত ও খই বানিয়ে খেতে। অভাবের সংসারে এই ঢ্যাপ ও শালুক আশীর্বাদ হয়ে আসতো।
গ্রামের চক জুড়ে থাকতো এই শাপলা-শালুক এখন তো এগুলো চোখেই পড়ে না। তবে বর্ষা মৌসুমে এই বিলে আসলে কিছুটা শাপলা দেখা যায়। কিন্তু আমরা এবার এই বিলে ঘুরতে এসে কোন শাপলা দেখতে পেলাম না।
তিনি আরো বলেন, খাল, বিল ও আবাদি জমি ভরাট করে ঘরবাড়ি, পুকুর ও মাছের ঘের তৈরি হচ্ছে। এতে খাল-বিলের পরিমাণ কমছে। শাপলার জন্মানোর জায়গা দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সে কারণেই জাতীয় ফুল শাপলা ও শালুক হারিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলেও ঢ্যাপের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
দর্শনার্থী রেহানা বেগম জানান, আগে আমরা দেখতাম বর্ষা মৌসুমে খাল ও বিলে সাদা শাপলা ফুল দিয়ে ঢাকা থাকতো। আমরা দলবেঁধে নৌকা নিয়ে বিল থেকে শাপলা, ঢ্যাপ ও শালুক তুলে আনতাম। ঢ্যাপ দিয়ে খৈ ভাজতো, শালুক পোড়া দিয়ে খেতাম। ঢ্যাপের খৈ আর শালুক পোড়া খাওয়ার স্বাদ যেন এখনো এই বয়সেও মুখে লেগে আছে।
টাঙ্গাইল শহরের পার্ক বাজারে শাপলা বিক্রি করতে আসা কৃষক আশরাফ মিয়া বলেন, আগের মত বন্যা না হওয়ার কারণে খাল-বিলে পানি না থাকার কারণে শাপলার জন্মায় না বিধায় শাপলা ও ঢ্যাপ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। আমি টাঙ্গাইলের বিভিন্ন বিল থেকে ঘুরে ঘুরে শাপলা সংগ্রহ করে এনে পার্ক বাজারে বিক্রি করি। তবে এখন আর আগের মতো শাপলা পাওয় যায় না।
কৃষক মজনু মিয়া বলেন, আগে যখন অভাব দেখা দিত তখন আমরা শাপলার ঢ্যাপ দিয়ে ভাত ও খই বানিয়ে খেতাম। এখন তো এগুলো পাওয়া খুব কঠিন। আমি বিভিন্ন বিল থেকে শালুক তুলে এনে বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখি। তবে আগের মত আর শালুক পাওয়া যায় না। যেটুকু শালুক সংগ্রহ করা যায়, সেই শালুক গরম পানিতে সিদ্ধ করে বিভিন্ন হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করি। শুধু গ্রামের হাট-বাজারের নয়, বেশি শালুক তুলতে পারলে সেগুলো সিদ্ধ করে বস্তায় ভরে টাঙ্গাইল শহরে নিয়ে বিক্রি করি। গ্রামের চেয়ে শহরে আরও বেশি দামে বিক্রি করা যায়। গ্রামের হাট-বাজারে প্রতি কেজি শালুক ১০০ থেকে ১২০ টাকা দামে বিক্রি করছি। আর শহরে নিতে পারলে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়।
শিক্ষক ও চিত্রগ্রাহক কামাল হোসেন বাসসকেক জানান, দিন দিন আবহাওয়া ও জলবায়ু সবকিছুই যেন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ষড়ঋতুর সেই দেশ আর নেই। বর্ষার সাথে সাথে শাপলা হ্রাস পাচ্ছে। এখন আর ঢ্যাপ দেখা যায় না। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই ঢ্যাপ কি চেনা তো দুরে থাক নামই জানে না। শাপলার জন্মানোর জায়গা দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আর তাই আগামী প্রজন্মের কাছে শাপলা-ঢ্যাপ শুধুই বইয়ের পাতার ছবি হয়ে থাকবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আশেক পারভেজ বাসসকে জানান, শাপলা দেশের জাতীয় ফুল। অথচ আজ তা টিকিয়ে রাখা নিয়েই তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। টাঙ্গাইলের গোপালপুর, ভুয়াপুর, কালিহাতি, নাগরপুর, বাসাইল উপজেলায় বিল ও আবাদি জমিতে কিছুটা শাপলার দেখা মিললেও তা পর্যাপ্ত নয়। প্রকৃতির এই সম্পদ হারিয়ে গেলে শুধু একটি ফুলই বিলীন হবে না, বিলীন হবে এক টুকরো গ্রামীণ ঐতিহ্য। হারিয়ে যাবে এক সময়ের বহুল ব্যবহৃত পুষ্টিকর খাদ্য এবং চিকিৎসার সহজ উপাদান। শুধু খাল-বিল ভরাট নয়, জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলেও শাপলা ও ঢ্যাপের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
তিনি আরো জানান, শাপলা মূলত বর্ষা মৌসুমেই বেশি জন্মায়। এখন আর আগের মতো বর্ষা হয় না। বৃষ্টি ও বর্ষার পানির অভাবে বর্তমানে খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে ইরি-বোরো,আউশ ধান, পেঁয়াজ, মরিচ, সরিষা, ভুট্টা, আলু ও গমসহ বিভিন্ন জাতের রবিশস্য চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পুকুর, আবদ্ধ জলাশয়গুলোতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করায় এ শাপলা জন্মানোর ক্ষেত্রগুলো দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতে আরও যোগ হয়েছে। প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংস হওয়ায় শাপলা-ঢ্যাপ উৎপাদন কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। তবে সরকার চাইলে কৃষি অফিস থেকে আমরা শাপলা, শালুক ও ঢ্যাপ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।