বাসস
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:২৩

সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি, রায় ও আদেশে বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ছে

সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল ছবি

// দিদারুল আলম //

ঢাকা, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে মামলার শুনানি, রায় ও আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ছে।

আগে বাংলায় রায় ও আদেশের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলা ভাষায় আদেশ ও রায় দেয়ার চর্চা বাড়ছে। দিনে দিনে এ চর্চা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মহান ভাষা আন্দোলনের মাসে আজও এক মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম ও বিচারপতি মো. হামিদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ রায় দেন।

তিন দশকের বেশি সময় আগে পাবনার ঈশ্বরদীতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে গুলি ও বোমা হামলার অভিযোগে করা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), আপিল ও জেল আপিলের ওপর আজ বাংলায় রায় দেন আদালত। বাংলায় রায়ের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত অংশটুকু আদালত ঘোষণা করেন। রায়ে সব আসামি খালাস পান। রায় ঘোষণার আগে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, মামলার বিষয়বস্তু বিস্তৃত। চুম্বক পয়েন্ট ও সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণা করা হবে। ফেব্রুয়ারি মাস মহান ভাষা আন্দোলনের মাস। ঐতিহাসিক এ ঘটনা ১৯৫২ সালের। রায়টা বাংলায় দেওয়া হচ্ছে। এরপর রায়ের পর্যবেক্ষণসহ সিদ্ধান্ত অংশটুকু ঘোষণা করা হয়।

এখন ওয়েবসাইটে সুপ্রিমকোর্টের সব রায় বাংলায় দেখা যাবে। ইংরেজি ভাষায় দেওয়া সুপ্রিমকোর্টের সব রায়-আদেশ বাংলা ভাষায় দেখাতে প্রযুক্তিসেবা সংযোজন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ইংরেজিতে দেয়া রায় বা আদেশ গুগল ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে বাংলায় অনুবাদ হয়। জনসাধারণের বিচার-প্রক্রিয়ায় সহজ অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের অভিপ্রায়ে বাংলায় অনুদিত রায় আদেশ দেখার ব্যবস্থা রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা জানান, এ প্রযুক্তির সংযোজন ও উদ্বোধন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক সময়োপযোগী নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ প্রযুক্তিসেবা উদ্বোধনের পর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন জানায়, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত সব রায়-আদেশ গুগলের প্রযুক্তির সহায়তায় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, বা যেকোনো ব্যক্তি নিজে নিজেই বাংলায় অনুবাদ করে দেখতে পারবেন। এ জনমুখী প্রযুক্তি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে এমনভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি ইংরেজি ভাষায় দেয়া যেকোনো রায় বা আদেশ, তা যত বড়ই হোক না কেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তা বাংলায় অনুবাদ করে দেখতে পারছেন।

সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন জানায়, সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিচারপতি নিয়মিতভাবে বাংলা ভাষায় রায়-আদেশ দিয়ে থাকেন। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত ‘আমার ভাষা’ নামে প্রযুক্তির মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায়-আদেশ বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে ২০২১ সাল থেকেই।

দেশের নিম্ন আদালতে কিছু-কিছু ক্ষেত্র ছাড়া শুনানিসহ বেশির ভাগ মামলায় রায় ও আদেশ বাংলায় দেয়া হয়। বৃটিশ ল’-এর আধিক্যসহ নানা কারণে সুপ্রিমকোর্টে ইংরেজি চর্চা সুদৃঢ় ছিল। দিনে-দিনে সুপ্রিমকোর্টে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের বাংলায় শুনানি ও যুক্তি পেশ ত্বরান্বিত হচ্ছে। ইংরেজির পাশাপাশি শুনানিকালে আদালতের নানা জিজ্ঞাসায়ও দেখা যায় বাংলার ব্যবহার।

বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে বেশ কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী, বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান, বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা চর্চা সমৃদ্ধ করতে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে বাংলা ব্যবহার বিষয়ে রায় রয়েছে উচ্চ আদালতের। যদিও এ রায় পুরোপুরি বাস্তবায়নে এখনো ঘাটতি বিদ্যমান।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের এডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া বাসস'কে বলেন, আমাদের মাতৃভাষা বাংলার রয়েছে সমৃদ্ধ ও গৌরবের ইতিহাস। দেশের প্রচলিত আইনগুলো বাংলা ভাষায় নিশ্চিত করতে হবে। আদালতের রায় ও আদেশ বাংলায় হলে সাধারণ মানুষেরও বুঝতে সুবিধা হয়। উচ্চ আদালতে এখন বাংলায় রায় দেয়া বাড়ছে। ফলে বিচারপ্রার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতসহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ করতে এর চর্চা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ইংরেজি, স্প্যানিস, চাইনিজ, জাপানিজ, জার্মানি, আরবি, হিন্দি ভাষা যেমনি বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে তেমনি আমরাও পারি বাংলাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো সমৃদ্ধ করতে। শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা বিশ্বমন্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন এবং দিনে-দিনে আরো এগিয়ে যাচ্ছেন। এদেশে যেমন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়ছে তেমনি বাংলাদেশীরাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছেন। এ সুযোগে বাংলাকেও পৌছেঁ দিতে হবে বিশ্বমন্ডলে। আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে বিশ্ব শান্তি মিশনে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশী সেনারা সেখানে বাংলাকেও পৌছেঁ দিয়েছেন। এ উদাহরণ তুলে ধরে এডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি সাফল্যের উদহারণ। এটি আমাদের অনুসরণ করতে হবে। ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশী ভাষা রপ্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রবণতা রয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে এটিও প্রয়োজন। পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলার চর্চা ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুদৃঢ় করতে মনোযোগী হতে হবে আমাদের সবাইকে। এতে করে বিশ্বমণ্ডলে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধ হবে।