খুলনা, ১৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ফুলগাছি গ্রামের বাসিন্দা মো. আলম শেখ বাণিজ্যিকভাবে ধুন্দল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
সম্প্রতি ডুমুরিয়ার নবনির্মিত টিপনা-শোভনা সড়ক ধরে যাওয়ার সময় গোনালী গ্রামে চোখে পড়ে মনোমুগ্ধকর ধুন্দল ক্ষেত। সবুজ লতা ভর্তি জমিতে ফুটে থাকা উজ্জ্বল হলুদ ফুল পথচারীদের দৃষ্টি কাড়ে।
ক্ষেতের মালিক আলম শেখ জানান, তিনি ইতোমধ্যে ধুন্দল সংগ্রহ শুরু করেছেন। পথচারী ও বাগানপ্রেমীরা রোজই দাঁড়িয়ে ফুল ও ফলের সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
বর্ষার শুরুতে এমন সবজি চাষ করে অনেক কৃষকই ভালো লাভের মুখ দেখছেন। গোনালী, টিপনা, ভদ্রদিয়া, বরাতিয়া, শোভনা, বান্দা ও পেরিখালি—এসব গ্রামে ধুন্দল চাষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। একসময় যেখানে এই ফল বনজ উদ্ভিদ হিসেবে জন্মাত, এখন তা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান ও জীবিকা দুটোই বাড়ছে।
বাসস’কে আলম শেখ বলেন, ‘আমি নিয়মিত সবজি চাষ করি। এখন ধুন্দল সহ আরও কিছু সবজি চাষ করছি। কম রাসায়নিক ও অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করি। নিজেই ক্ষেতের দেখাশোনা করি। নিজ পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করেও আয় হয়।’
তিনি জানান, ‘আগে ছয় সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। এখন টানা দুই বছর ধরে প্রায় ৪০ শতক জমিতে ধুন্দল চাষ করছি। চৈত্র থেকে শ্রাবণ পর্যন্ত প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ করে তিন মণের বেশি ধুন্দল মাঠ থেকে তুলেছি।’
আষাঢ়ের মাঝামাঝি প্রথম ফসল কাটা শুরু হয়। আলম বলেন, ‘প্রথম দিকে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। ধুন্দুল ছাড়াও করলা, বরবটি, শসা ইত্যাদি চাষ করে বছরে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা আয় হয়।’
তবে সমস্যাও রয়েছে। তিনি জানান, বন্যার কারণে আরও ৬০ শতক জমি চাষ করতে পারেননি। জমি তলিয়ে গেছে।
তবে তিনি জানান, এমন কঠিন সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) পাশে ছিল।
টিপনা গ্রামের কৃষক ফারুক সরদারও একই রকম সাফল্যের গল্প শোনান। তিনি বলেন, ‘আগে অল্প জমিতে ধুন্দল চাষ করতাম। এখন বাণিজ্যিকভাবে করছি। তিন বিঘা জমি থেকে প্রতি মৌসুমে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা আয় হয়।’
খুলনা কৃষি বিভাগ জানায়, আগে থেকেই ধুন্দল চাষ হতো, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে। কম খরচ, বেশি চাহিদা ও দ্রুত ফলন পাওয়ায় চাষ বেড়েছে। চলতি বছর উৎপাদনও বেড়েছে।
ক্ষেত পরিদর্শনে দেখা গেছে, কৃষকরা তাদের জমিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন, কেউ গাছ থেকে ধুন্দল তুলছেন, কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন, কেউ আবার কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে কীটনাশক দিচ্ছেন। বীজ বপনের ৫০ থেকে ৫৫ দিন পর ফসল তোলা শুরু হয় এবং ৩ থেকে সাড়ে ৩ মাস পর্যন্ত তা চলে। শুরুতে ৪০-৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন তা ২৫-৩০ টাকায় নামছে।
প্রতি বিঘা (প্রায় ৩৩ শতক) জমি থেকে গড়ে ৫০ মণ (প্রায় ২ হাজার কেজি) ধুন্দল পাওয়া যায়। খরচ পড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা। আর আয় হয় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত, যা অন্য অনেক ফসলের চেয়ে লাভজনক।
কৃষক সাইফুল ইসলাম ও আইয়ুব আলী জানান, ধুন্দল তুলনামূলকভাবে কম পরিচর্যার ফসল। পোকামাকড়ও কম হয়। মৌসুমের শুরুতে পানির ঘাটতি থাকলেও কৃষি অফিসের সহায়তায় তা সামাল দেন।
তারা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার জমিও বেড়েছে, ফলনও বেশি হয়েছে। ফলে লাভ বাড়ছে। আগে পতিত থাকা জমিগুলোও এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে গ্রামীণ আয় বাড়ছে।
টিপনা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নুরুন্নাহার জানান, এলাকার প্রায় প্রতিটি পরিবার এখন কোনো না কোনো সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, ‘ধুন্দল চাষ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে।’
ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, ‘ডুমুরিয়ার সবজি শুধু খুলনা নয়, আশপাশের জেলাতেও যাচ্ছে। ধুন্দল যেমন পুষ্টিকর, তেমনি লাভজনক। আমরা কৃষকদের প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)’র খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, খুলনা অঞ্চলে বর্তমানে ২০ হাজার ৫৬৯ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ টন। তবে গত দুই সপ্তাহের ভারী বৃষ্টির কারণে ১ হাজার ৯১৭ দশমিক ৭৫ হেক্টর জমি ডুবে গেছে। ফলে প্রায় ৯৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।