
ইব্রাহিম খলিল মামুন
কক্সবাজার, ৬ নভেম্বর ২০২৫(বাসস): জীববৈচিত্র্য ও ম্যানগ্রোভ বন সমৃদ্ধ সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ইতোমধ্যে এই দ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ পরিচালিত হয়েছে। পর্যবেক্ষণকালে সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও বাসিন্দাদের জীবন মানোন্নয়নে সোনাদিয়াবাসীর মতামত গ্রহণ করা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সোনাদিয়া দ্বীপে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে জমি দখলমুক্ত করা, খালের মুখ ও শাখা-প্রশাখার বাঁধ অপসারণ করে জোয়ারের পানি প্রবাহ সুগম করা, বালিয়াড়ি পুনরুদ্ধার এবং সৈকত সংরক্ষণ এবং ম্যানগ্রোভ ও নন-ম্যানগ্রোভ গাছের চারা রোপণ করা হবে। এ ছাড়াও দ্বীপের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ২৬ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফাহমিদা হক খানের নেতৃত্বে একটি পর্যবেক্ষক দল সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শন করেন। এসময় তারা দ্বীপের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন। এসময় তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময়কালে পর্যবেক্ষক দল সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন মানোন্নয়নে স্থানীয়দের মতামত গ্রহণ করেন। পরিদর্শন দলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা।
উপপরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা বাসসকে বলেন, কীভাবে দ্বীপের হারিয়ে যাওয়া পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ফিরে আসবে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মানোন্নয়নে কী করা উচিত এসব বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এসব পরামর্শের আলোকে সরকার কাজ করবে।
তিনি বলেন, এত সুন্দর একটি দ্বীপ চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে তা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। তাই সরকার সোনাদিয়া দ্বীপকে পুনরুদ্ধারের জন্য বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে ফিরে আসবে সোনাদিয়া দ্বীপের হারিয়ে যাওয়া পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ছোট্ট দ্বীপ ‘সোনাদিয়া’। ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় বনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বীপটির আয়তন নয় হাজার বর্গকিলোমিটার। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে সমুদ্র সৈকত। একটা সময় সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ ছিল। ছিল গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসা মা কচ্ছপের বিচরণ। প্যারাবনে বিলুপ্ত প্রজাতি চামচ ঠুঁটো (স্যান্ড পাইপার) পাখিসহ শত প্রজাতির পাখির মেলা বসত। এখন তার কিছুই নেই। প্যারা বন উজাড় করে চিংড়ি ঘের তৈরি হয়েছে। দখল ও দূষণে দ্বীপের বিরল প্রজাতির পাখপাখালি, বৃক্ষ ও লতাগুল্মও ধ্বংস হওয়ার পথে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র আরো জানায়, ২০১৭ সালে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার শর্তে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)কে মাত্র ১ হাজার ১ টাকায় এ ভূমি বরাদ্দ দিয়েছিল কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। তখন দেশের বৃহত্তম ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ার জন্য পরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেয় বেজা। মাহিন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারিং নামে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানকে এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ দেওয়া হয়।
ইকোপার্কের জন্য জমি দেওয়ার পর সোনাদিয়া দ্বীপে গাছ কাটা, চিংড়ির ঘের নির্মাণসহ বিভিন্ন পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এমনকি প্যারাবন কেটে চিংড়ি ঘের গড়ে তোলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একাধিক মামলাও হয়েছে।
সোনাদিয়া দ্বীপে এসব কার্যক্রমের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অনুরোধে বেজাকে দেওয়া সোনাদিয়া দ্বীপের ভূমি বন্দোবস্ত বাতিল করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। গত ৫ মে ভূমি মন্ত্রণালয়ের খাসজমি-২ শাখার উপসচিব মাসুদ কামাল স্বাক্ষরিত এক স্মারকে এ তথ্য জানানো হয়। এর ফলে দ্বীপের ৯ হাজার ৪৬৭ একর ভূমি পুনরায় ফিরে পাচ্ছে বন বিভাগ।
কক্সবাজার ভিত্তিক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বলেন, একসময় এই দ্বীপে ছিল ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৫২ প্রজাতির শামুক, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ৯ প্রজাতির চিংড়ি, ২০৭ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২০৬ প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং পরিবেশ বিনষ্টের কারণে অনেক কিছুর বিলুপ্তি ঘটেছে। হুমকিতে আছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য। এরমধ্যে ইকোট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠার নামে অবশিষ্ট প্রাকৃতিক-সম্পদও ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। পৃথিবীতে যে ৩০০এর মতো চামচ ঠুঁটো কাদাখোঁচা (স্যান্ড পাইপার) পাখি আছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশের বাসভূমি ছিল সোনাদিয়ার প্যারাবন। প্যারাবন উজাড় করে চিংড়ি ঘের নির্মাণ করায় চামচ ঠুঁটোসহ অন্যান্য পাখির বিচরণ এখন আর চোখে পড়ে না।
তিনি বলেন, সরকারের এ উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন হলে সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ফিরে আসবে। বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায়ও তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।