/জাহিদুল ইসলাম/
নরসিংদী, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস): নরসিংদী জেলার প্রাণকেন্দ্র বড় বাজার। প্রতিদিন এখানে ভিড় জমে হাজারো মানুষের। তাদের প্রাণচাঞ্চল্যে জমে ওঠে ব্যবসা। এই কোলাহলের ভিড়ে আছে এক বিশেষ পেশাজীবী গোষ্ঠী। তারা হলেন ছাতার কারিগর। যাদের হাতের ছোঁয়ায় পুরোনো ছাতা ফিরে পায় নতুন জীবন। আধুনিকতার ভিড়ে পেশাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। খানিক অপ্রচলিত এ পেশা জীবিকার জন্য সংগ্রামমুখর।
সরেজমিনে বড় বাজারে দেখা যায়, বাজারের এক কোনায় সারি সারি ছোট দোকান, যেখানে ঝুলছে নানা আকারের ছাতা। কোনো কোনো কারিগর ছাতার হাতল ঠিক করছেন, কেউ আবার ছেঁড়া কাপড়ের জায়গায় নতুন কাপড় সেলাই করে দিচ্ছেন।
এ সময় জানা যায়, আগে বর্ষাকালে ছাতা মেরামতের প্রবণতা ছিল বেশি, কিন্তু এখন চাহিদা কমেছে। কারণ বাজারে সস্তা দামে নতুন ছাতা পাওয়া যায় সহজেই। ফলে কারিগরদের আয়ও কমছে দিন দিন।
৬০ বছরের প্রবীণ কারিগর আব্দুস সালাম বলেন, আমি ৪০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। এক সময় দিনে ৫০-৬০টি ছাতা মেরামত করতাম, এখন ৫-১০টা হলেই আলহামদুলিল্লাহ বলি।
তার পাশে রয়েছেন আরও দুজন কারিগর, যারা ছাতা মেরামতের পাশাপাশি তালা মেরামত করছেন। নরসিংদীর এ বাজারটিতে মাত্র ৩ জন কারিগরের দেখা পাওয়া যায়। তবে, তারা নিয়মিত কাজে যোগ দেন না।
তারা জানান, আগে মানুষ নতুন ছাতা কিনতে সাহস করত না সহজে, মেরামত করে ব্যবহার করত বহুদিন। কিন্তু এখন চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা কমদামের ছাতার কারণে পুরোনো ছাতা ঠিক করানোর আগ্রহ মানুষের কমেছে। ফলে আয় কমে যাওয়ায় পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
কারিগররা বলেন, এ পেশার অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো ঋতুভিত্তিক চাহিদা। শুধু বর্ষাকালে কিছুটা কাজ থাকে ছাতার, বছরের বাকি সময় প্রায় বেকার থাকতে হয়। একজন কারিগর দিনে গড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা রোজগার করতে পারেন। বর্ষাকালে আয় কিছুটা বাড়লেও তা দিয়ে সংসারের খরচ চালানো কঠিন।
তারা আরও বলেন, ফ্যাক্টরিতে কাজের সুযোগ থাকায়, নতুন প্রজন্ম এই পেশায় আসছে না। কারণ এ পেশায় আয় কম, পরিশ্রম বেশি।
কারিগর আমিনুল ইসলাম জানান, আমাদের সন্তানরা এই কাজ করতে চায় না। তারা বলে, এত কষ্ট করে লাভ কী? তাই অন্য পেশা খুঁজছে।
তবে ছাতার কারিগররা হাল ছাড়েননি। এখন তারা ছাতার পাশাপাশি ব্যাগ, পার্স, বেল্ট ইত্যাদি মেরামত করছেন। কেউ কেউ নতুন ছাতা বিক্রির পাশাপাশি মেরামতের কাজ করছেন, যাতে কিছুটা বাড়তি আয় হয়।
কারিগরদের দাবি, যদি সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন তাদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তবে তারা নতুনভাবে কাজের সুযোগ পেতে পারেন। অনেকেই চান, ছাতা মেরামতের সঙ্গে সেলাই, ব্যাগ তৈরি ইত্যাদি দক্ষতা অর্জন করতে, যাতে আয়ের নতুন পথ খুলে যায়।
রায়পুরার কারিগড় কাউছার মাহমুদ বলেন, নরসিংদীর বড় বাজারের ছাতা কারিগররা এক অর্থে ঐতিহ্যের ধারক। হয়তো পেশাটি এখন বিলুপ্তির পথে, কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে বিশেষ করে বর্ষার দিনে তাদের কাজের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। তাই এই পেশার মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী পদক্ষেপ দরকার। না হলে একসময় ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে ছাতা কারিগরদের নাম।
নরসিংদী বাজার বণিক সমিতির সভাপতি বাবুল সরকার বলেন, নরসিংদীসহ সারাদেশের বাজারে চায়নাসহ বিভিন্ন ব্রান্ডের ছাতা সহজে ও কম দামে পাওয়া যায়। ফলে ছাতা মেরামত না করে নতুন ছাতা কেনার দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। ছাতা কারিগরদের আয়-রোজগার কমে যাওয়ার মূল কারণ এটি। এ কারণে পেশাটি হারিয়ে যেতে বসেছে।