‘স্বপ্নডানা’য় স্বাবলম্বী ইলোরা 

বাসস
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:০৩
ছবি : ফেসবুক

ঢাকা, ১৬ নভেম্বর,২০২৫(বাসস): রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে ইলোরা আফরোজ রিমু আর পাঁচজনের মতো ভেবেছিলেন ৯-৫টা চাকরি করবেন। আয়-রোজগার করে পরিবারে আর্থিক সহায়তা করবেন। চাকরিও করেছেন বেশ ভালো বেতনের। কিন্তু তা আর বেশিদিন করতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হয় সেই চাকরি। 

সন্তান লালন-পালন আর পরিবারেই মন দিতে হয় তার। তবে মন যেন কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। কী যেন করতে চায়! তিনি এমন কিছু চাইছিলেন যেখানে জীবন ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা থাকবে না। থাকবে না কোনো অযাচিত নিয়মের বেড়ি। থাকবে নিজের স্বাধীন মতো কিছু করার। আবার তা হতে হবে সচ্ছলতার মূলসূত্র। অর্থাৎ তিনি চান উড়তে, সুপ্ত স্বপ্নডানায় ভর করে সচ্ছল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে। 

আর সেই ডানায় চড়েই যেন উড়ে চলেছেন নারী উদ্যোক্তা ইলোরা। বৈশ্বিক বিনিয়োগ ও উদ্যোগে প্রজন্মগত পরিবর্তনের অংশ হিসেবে জেন-জি-রা বাংলাদেশেও আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের উদ্যোগে মনোনিবেশ করছে। তাদেরই এক প্রতিনিধি ইলোরা। 

সম্প্রতি আলাপচারিতায় ইলোরা আফরোজ রিমু তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনালেন। যেখানে উঠে এসেছে তার পড়াশোনা থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা জীবনের নানা উত্থানের কথা। ইলোরা বলেন, স্নাতকোত্তর শেষে অল্পকিছু দিনের মধ্যেই একটি তৈরি পোশাক কারখানার মানবসম্পদ বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করি। এর মাঝেই পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। 
একপর্যায়ে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাংলাদেশ ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিআইএম) থেকে পিজিডি সম্পন্ন করেন ইলোরা। এতে নিজক্ষেত্রে আরও ভালো করার সুযোগ পান তিনি। 

এর মাঝেই ইলোরার ঘর আলো করে আসে প্রথম সন্তান। এ পর্যায়ে সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি চাকরি করা ইলোরার পক্ষে একটু কঠিন হয়ে পড়ে। যা তাকে মানসিকভাবে কষ্টও দিচ্ছিলো। অর্থাৎ অফিস সামলে পরিবার আর সন্তানকে সময় দিতে পারছিলেন না তিনি। এক পর্যায়ে হতাশ ইলোরা চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। 

ইলোরা বলেন, ‘তবে বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। অন্যরা যেখানে চাকরি পায় না, আমি সেখানে ভালো বেতন ও পরিবেশের একটি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এটা আমায় বেশ মানসিক যন্ত্রণা দিত।’ 

তবে এই কষ্টকে নতুন করে অন্যভাবে শক্তি অর্জন করে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন ইলোরা। সব দিক বিবেচনা করে অল্প পুঁজি নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ২০২০ সালের ১ জুলাই ‘স্বপ্নডানা’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। যেহেতু পুঁজি কম তাই দোকান বা শো-রুম নেওয়ার সাহস হয়নি। অনলাইনের উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেই এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। 

ইলোরা বলেন, নিজ এলাকা কুষ্টিয়ার কুমারখালীর টেক্সটাইলের বেডশিট, বেড কভার, গামছা, লুঙ্গি দিয়েই শুরু করি। যেহেতু খুলনায় বসবাস করি সেই সুবাদে সুন্দরবনের খাঁটি মধু নিয়েও কাজ শুরু করি। 

পরে আরও কয়েকটি খাদ্যপণ্য যুক্ত হয় তাঁর অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘স্বপ্নডানা’য়। 

কেন উদ্যোক্তা হলেন-এমন প্রশ্নের জবাবে ইলোরা বলেন, ‘আসলে আমার প্রথম সন্তান জন্মের পর ছেলে অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছেলেকে নিয়ে এদিক-সেদিক ডাক্তারের কাছে ঘুরতে ঘুরতে আমার মাথা থেকে চাকরি করার চিন্তা দূর হয়ে যায়। একপর্যায়ে গিয়ে আমার সন্তান সুস্থ হলো। কিন্তু আমার জীবনের হতাশা কমলো না। নিজে কিছু করতে না পারার দহনে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। 

‘‘বছরের পর বছর হতাশায় ভুগতে ভুগতে চিন্তা করতে লাগলাম এমনকি কোনো কাজ আছে, যা করলে আমার সন্তানদের দেখাশোনা করতে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তখন ছোট বোনের পরামর্শে অনলাইনে পেজ তৈরি করি। প্রথমে বাচ্চাদের খাবার নিয়ে কাজ করার চিন্তা ছিলো। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতায় তা হয়ে ওঠেনি। এরপর আসে করোনা মহামারি। এই সময়ে শুরু করলাম ‘স্বপ্নডানা’-এর মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসা।’’

ইলোরার ‘স্বপ্নডানা’ উদ্যোগের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে পরিবারের লোকজনের সহযোগিতা তো রয়েছেই। 

এও জানালেন, শুরুতে উদ্যোগটি দাঁড় করাতে কুষ্টিয়ার টেক্সটাইল মিল মালিকেরাও বেশ সহযোগিতা করেন। তারা তাদের কারখানা থেকে বেডশিট, লুঙ্গিসহ পণ্যগুলোর ছবি দেন। মূল্য সম্পর্কেও সঠিক ধারণা দেন। 

স্বামী ছাড়াও ইলোরার বাবা-মা প্রতিনিয়ত মেয়েকে ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এজন্য তাদের প্রতি বেশ কৃতজ্ঞ তিনি। এসব বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার বাবা এখনো নিয়মিত কুমারখালী থেকে পণ্যগুলো সংগ্রহ করে কুরিয়ার করেন আমার কাছে। আর স্বামী সার্বিক দেখভাল করেন। 

‘স্বপ্নডানা’-এর সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আসলে অনলাইন ব্যবসায় মাসে নির্দিষ্ট কোনো আয় থাকে না। বর্তমানে মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় হয়। আবার কোনো উৎসব পার্বণে তা লাখ ছাড়িয়ে যায়।’

ইলোরা জানান, দিনের নির্দিষ্ট সময়ে নয়, সুযোগ মতো সময় নির্বাচন করে ব্যবসার কাজ করছি। ব্যবসার প্রয়োজনে কিছু লোকজন রয়েছেন যারা আমার জন্য কাজ করেন। এতে তারাও স্বচ্ছলভাবে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। 

‘যেহেতু আমার ব্যবসায় খাদ্য পণ্যও রয়েছে। আর তা হচ্ছে ঋতুভিত্তিক। কয়েকজন স্থায়ী বাদে বাকি শ্রমিকও রয়েছেন সেভাবে। যেমন শীত মৌসুমে খেজুর গুড় সংগ্রহে দু’জন, কুমড়ো বড়ি-তে তিনজন, মধু সংগ্রহের জন্য তিনজন মৌয়াল রয়েছেন। আর বাসায় স্থায়ীভাবে দুইজন রয়েছেন।’

তিনি বলেন, তাঁতপণ্য আমি নিজেই এলাকার বিভিন্ন টেক্সটাইল মিল ও তাঁতিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি এবং অর্ডার অনুযায়ী তা পাঠিয়ে দিই।

ইলোরার স্বপ্নডানা থেকে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় খাদ্যপণ্য। তিনি বলেন, ‘ভেজালের এই যুগে খাঁটিপণ্য সরবরাহের চ্যালেঞ্জটা আমার কাছে খুব আনন্দের ছিল। খাদ্যপণ্যে মানুষের আস্থা পাওয়া খুব সহজ। 

একবার পণ্য ক্রেতার মন কেড়ে নিলে বারবার অর্ডার পাওয়া সম্ভব। এই কাজে আমার পরিশ্রম বেশি হলেও তৃপ্তি অনেক। আমার কাজের সঙ্গে বেশ কিছু মানুষের শ্রম জড়িয়ে রয়েছে। 

এছাড়া বিভিন্ন ধরনের আচার, চুইঝালের আচার, হানিনাটস্ও তৈরি করে গ্রাহকের কাছে অর্ডার অনুযায়ী পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। 

নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইলোরা বলেন, আমি মনে করি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের আরও এগিয়ে আসা উচিত। চাকরি করেই যে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে বিষয়টা সে জায়গায় না রেখে নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোলে নিজের উদ্যোগেও সফল হওয়া সম্ভব। 

ইলোরা বলেন, ‘আসলে আমি মনে করি সমাজের প্রতিটি নারীর নিজস্ব একটি পরিচয় থাকা উচিত। 

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আমি স্বপ্ন দেখি সমাজে সম্মানজনক একটি অবস্থানের। যেখানে আমার কাজের মাধ্যমে আমাকে মানুষ জানবে, আমাকে চিনবে।’

তবে অনলাইনে উদ্যোগ পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ার কথাও জানান তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইলোরা বলেন, আশপাশের লোকজনের অনেক নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়। এছাড়া পণ্যের সঠিক দাম পেতে কষ্ট হয়। এই ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিস একটি বড় সমস্যা। 

কুরিয়ারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রাহকের পণ্য পৌঁছাতেও বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে কুরিয়ার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে আরও আন্তরিক হওয়া জরুরি। 

সবশেষ নিজের উদ্যোগের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইলোরার মন্তব্য, ‘আমার আব্বু ছিলেন রঙ ও সুতা ব্যবসায়ী। 

আব্বুর সরলতা আব্বুকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দেয়নি। আমার ইচ্ছে আছে আমি ছোট্ট একটা কারখানা করবো। সে কারখানা হবে লুঙ্গি ও তোয়ালের। আর কুমারখালীর তাঁতপণ্য নিয়ে বড় কোনো শহরে একটি শো-রুম থাকবে।’ 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রের কাঠামো যুগোপযোগী করা সময়ের দাবি : ড. মোবাশ্বের মোনেম
সিলেটে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক ঐক্যের আদি নববর্ষ উদযাপন
হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কড়া নিরাপত্তা
দিনাজপুরে গ্রাম আদালত কার্যক্রমের অর্ধ-বার্ষিক সমন্বয় সভা 
সরকারি ভবন পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন বিল্ডিং’ করার আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
প্রবাসী কর্মীদের সন্তানদের শিক্ষায় ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকার সহায়তা দিয়েছে সরকার
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ৪র্থ বর্ষের খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন শুরু মঙ্গলবার
রেলওয়ের লাগেজ ভ্যান ক্রয় প্রকল্পে ৩৫৮ কোটি টাকা ক্ষতি, দুদকের মামলা 
বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জামায়াতের
দোহায় বাংলাদেশ-কাতার সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে প্রেষণে জনবল নিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর
১০