শিরোনাম
প্রতিবেদন : মো.আককাস সিকদার
ঝালকাঠি, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : সেলিম তালুকদারের বয়স ছিল ৩২ বছর। তিনি ৩২ জুলাই বা ১ আগস্ট শহিদ হন। গত ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই ছিল তার ১৪ দিনের। সেলিমের মাথা, বুক আর পিঠে লেগেছিলো ৭৫টি ছররা গুলি। এক্স-রে ও সিটিস্ক্যানে ধরা পড়ে মাথায় ১৮টি ও বুক আর পিঠে ৫৭টি গুলি।
মৃত্যুরহস্য চাপা দিতে পুলিশ মৃত্যু সনদেও কেতাবী বয়ান মেনে নিতে বাধ্য করে পরিবারকে। এমনকি ১ আগস্ট রাজধানীর ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতালে পুলিশ মরদেহ জিম্মি করে রাখে সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। ১৮ জুলাই সেলিম গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও পুলিশের হয়রানির কারণে তাকে নিয়ে ১৪ ঘণ্টা কেবল এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। সবশেষ ভর্তি নিয়েছিলো পপুলার হাসপাতাল।
গত ১ আগস্ট সকালে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরে চিকিৎসক যখন সেলিমের লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলেন তখনও সেলিমের স্ত্রী জানতেন না তাঁর গর্ভে আরেকটি জীবন একটু একটু করে বেড়ে উঠছে! এই শহিদের জীবনে সবচাইতে আক্ষেপের শিরোনাম এটি। ১৮ বছর বয়সী সুমী আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো এক বছর আগে। মৃত্যুর ৩ দিন পর ৪ আগস্ট ছিলো তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। এই ৩৬২ দিনের বৈবাহিক জীবনের শেষ ১৪ দিনও স্ত্রীকে না বলা কথাগুলো বলতে পারেননি লাইফ সাপোর্টে থাকা সেলিম। বাবা ডাক তো দূরের
কথা, পিতৃত্বের খবরই তাঁর জানা হলো না। অথচ ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগের দিনও স্ত্রীর প্রেগনেন্সি টেস্ট করিয়েছিলেন। তখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তিনি বাবা হচ্ছেন।
বাসসকে সুমী আক্তার জানান, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) থেকে অনার্স সম্পন্ন করে নারায়ণগঞ্জ মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেলিম। মাস্টার্সে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য। ১৭ জুলাই রাতে অনার্সের আইডি কার্ডও বের করে রাখেন। ১৮ জুলাই সকালে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডের বাসা থেকে বের হন নাস্তা না করেই। মা সেলিমা বেগম খেয়ে বের হতে বলেছিলেন ছেলেকে। সকাল ১০টায় স্ত্রী ফোন করে বুঝতে পারেন তার স্বামী আন্দোলনে আছে। স্ত্রীকে জানান একটু পরেই বাসায় ফিরবেন।
এরপরেই রাজধানীর মেরুল বাড্ডার প্রগতি সরণীতে অবস্থিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বেলা ১১টায় তার স্ত্রীর ফোনে কল দিয়ে এক তরুণ জানায় আপনার স্বামী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। প্রথমে তাকে মুগদা হাসপাতালে নেয়া হয়। রক্ত থামানোর জন্য ব্যান্ডেজ ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালটি প্রশাসনিক চাপ এড়াতে আর রাখতে চায়নি সেলিমকে। একই কারণে বিভিন্ন হাসপাতালে গেলেও কোথাও সেলিমকে ভর্তি করা যাচ্ছিলো না। একই সঙ্গে আরেক সমস্যা কোথাও আইসিইউ বেড খালি ছিলো না। বেলা ১১টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টা গুলিবিদ্ধ সেলিমকে নিয়ে ঘোরাঘুরির পর ভর্তি ও আইসিইউ বেড মেলে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে।
হাসপাতালে ১৪ দিন পর মারা গেলে পুলিশ সেলিমের বাবাকে বাধ্য করেন লিখিতভাবে স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বীকারোক্তি দিতে। ১ আগস্ট সকাল থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর বাধ্য হয়ে পুলিশের সাজানো বয়ানে স্বাক্ষর করেন তিনি। এরপর মৃত্যু সনদ আর শোকের বহর নিয়ে স্বৈরাচারের শহর ত্যাগ করেন তারা। মা-বাবার আদরের খোকা শেষবারের মতো ফেরেন নিজের শহর ঝালকাঠির নলছিটিতে। তিন বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন সেলিম।
পরের দিন ২ আগস্ট সকালে কারফিউর মধ্যে নলছিটিতে জানাজা শেষে মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয় সেলিমকে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নলছিটি শহরের বাসস্ট্যান্ডে ‘বিজয় উল্লাস ৭১’ চত্বরকে ‘শহীদ সেলিম তালুকদার স্মৃতি চত্বর’ নাম দেন। এর দুদিন পরেই ছিলো তার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। চার আগস্টকে ঘিরে কয়েক মাস আগে থেকে ছিলো স্ত্রীর সঙ্গে কত পরিকল্পনা। এই দিনটিতেই আরেক দফা প্রেগনেন্সি টেস্ট করানো হয়। পরের দিন ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের সঙ্গে সঙ্গে আসলো আরেক খুশি আর আক্ষেপের খবর। শহিদের সন্তান পৃথিবীতে আসছে! শহিদ সেলিমের স্ত্রীর গর্ভকাল ছিলো সেদিন পর্যন্ত ৪ সপ্তাহ ৬ দিন। কিন্তু জেনে যেতে পারলেন না তিনি।
স্ত্রী সুমী জানান, চট্টগ্রামে তাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো। স্বামীর জন্য কিনেছিলেন পোশাক। কয়েক মাস আগে থেকে স্বামীর মুখেও ছিলো বিবাহবার্ষিকীতে চমকে দেয়ার ঘোষণা। স্বামী একটি কন্যা সন্তানের আশা করতেন সবসময়। এখন হয়তো গর্ভের এই সন্তানই হবে স্মৃতির স্মারক। কিন্তু স্ত্রী আর এই অনাগত সন্তানের জন্য আছে কি কোনো নিশ্চিন্তপুর? যদিও উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত স্ত্রী সুমী আক্তারের দাবি, নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে সন্তান নিয়ে কারো বোঝা হয়ে থাকতে হবে না তাকে। ঝালকাঠি শহরের কবিরাজ বাড়ি এলাকার মতিউর রহমান চুন্নুর মেয়ে সুমী আক্তার। তার বড়ভাই নাহিদুল ইসলাম ওমানপ্রবাসী। মেজোভাই ইলিয়াস হাওলাদার পড়াশোনা শেষ করেছেন। সুমী বিচার চান। তবে মরদেহ কবর থেকে তোলা বা ময়নাতদন্ত হোক এমন কিছু কোনোভাবেই চান না তিনি।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা-বাবাতো তাদের পৃথিবীকেই হারিয়ে ফেলেছে। পরিবারে সেলিম ছিলেন একমাত্র আশার আলো।
সেলিমের বাবা রেন্ট এ কার চালক সুলতান তালুকদার বলেন, একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছি, সেতো আর ফিরে আসবে না। তাই কোনো মামলার ঝামেলায় যেতে চাই না। মা সেলিমা বেগম আক্ষেপ করেন সকালের নাস্তা সন্তানকে সেদিন খাইয়ে দিতে না পারার জন্য।
তিনি বলেন, আরও ৩২ বছরেও শেষ হবে না ছেলে হারানোর জ্বালা।
সেলিমের অনাগত সন্তানের কথা ভেবেও মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার।
স্ত্রী সুমী জানান, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে শ্বশুর-শাশুড়িকে ১ লাখ ও তাকে ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। বিইউএফটি থেকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ২৩ নভেম্বর ৫ লাখ টাকার চেক দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ১০ হাজার টাকার সহায়তা চেক দেয়া হয়েছে।