অভাব আর বুলেটবিদ্ধ শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে শংকায় দিন কাটছে আহত রনির

বাসস
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৬

প্রতিবেদন: আনিচুর রহমান

ফরিদপুর, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী। এর মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হলেন মো. রনি।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এলেও প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর অনিশ্চয়তার কারণে রনি এখন মানবেতর  দিন পার করছেন। একদিকে ঋণের বোঝা, অন্যদিকে সংসারের অনটন, এছাড়া ভবিষ্যত চিকিৎসা নিয়ে শংকায় নির্ঘুম রাত কাটে রনি ও তার পরিবারের। পাঁচ মাস হয়ে গেলেও এখনও মেলেনি সরকারি কোনো সহায়তা।

গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলিতে আহত হন রনি(৩০)।গুলি তার মুখগহ্বর ভেদ করে মেরুদণ্ডের হাড়ের ডিস্কের মধ্যে বিদ্ধ হয়। এতে তার ঠোঁট, সামনের ৮টি দাঁত, জিহ্বা, মুখগহ্বরসহ মেরুদণ্ডের হাড়ের ডিস্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টানা তিন মাস বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন বাড়িতেই আছেন তিনি।

রনি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের দৈত্যরকাঠি গ্রামের এনামুল হোসেনের ছেলে। এক সন্তানের জনক মো. রনি রাজধানীর একটি কনস্ট্রাকশন সাইট দেখাশোনার কাজ করতেন। 

আন্দোলন শুরুর দিকে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে রনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। 

প্রতিদিনের মতো গত ৫ আগস্ট সকাল বেলা ছাত্র-জনতার সাথে বিক্ষোভরত অবস্থায় রাস্তায় ছিলেন তিনি।এ সময় বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে পতিত সরকারের ফ্যাসিস্ট আজ্ঞাবহ বাহিনী।

 

গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান রনি। আন্দোলনকারী অন্য ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে গুলশান ২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে মিরপুরের পূর্ব মনিপুর থেকে ছুটে আসেন রনির পিতা এনামুল হোসেন। তিনিও অপর একটি কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করতেন। ইউনাইটেড হাসপাতালেই প্রাথমিক চিকিৎসা চলে রনি’র। সেখানে বেলা সাড়ে তিনটা থেকে রাত অবধি জটিল অস্ত্রোপচার করেও গুলি বের করতে ব্যর্থ হন চিকিৎসকগণ। অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় চিকিৎসা খরচ বহন করতে হয় পরিবারকে। ব্যয়-বহুল ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা করার সামর্থ্য না থাকায় রাতেই সেখান থেকে ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলেকে স্থানান্তর করে পিতা এনামুল হোসেন। পপুলারে ১৮ দিন চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা সেবা নেওয়ায় প্রায় ১২ লক্ষ টাকা ব্যয় মিটাতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এ সময় এক সমন্বয়কের মাধ্যমে শুধুমাত্র ঔষধের বিল পরিশোধ করে ছাড় পান তারা।

পপুলার হাসপাতালের ঔষধের বিল ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা পরিশোধ করতে আত্মীয়-স্বজন, গ্রামবাসী ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিতে হয় রনির পরিবারকে। পরে সমন্বয়কদের মাধ্যমে সাভার সিআরপি হাসপাতাল ও ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সর্বশেষ সিআরপিতে কয়কে ঘন্টা ও ইবনে সিনায় ২ মাস ৭ দিন ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলে রনির।

বিভিন্ন হাসপাতালে থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাসের চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের বাম অংশ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্রায় প্যারালাইজড হয়ে পড়া শরীর নিয়ে কিছুটা হাঁটা চলা করতে পারছেন। কিন্তু শরীরে বয়ে বেড়ানো বুলেটের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেন না তিনি। ঘুমাতে পারেন না পরিবারের অন্য সদস্যরাও। দিনরাত তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হচ্ছে রনিকে। সব সময় কাউকে না কাউকে তার পাশে থাকতে হয়। তাই, তার মা, স্ত্রী ও বোন পালাক্রমে পাশে থাকে তার।

পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়,ঢাকায় থাকতে সমন্বয়করা তার বিস্তারিত তথ্য নিলেও এ পর্যন্ত সরকারি কোনো প্রকার সহযোগিতা পাননি তিনি। শুধুমাত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে তার চিকিৎসার ঔষধ বাবদ কিছু সহায়তা পাওয়া গেছে। স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ও জেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সদস্য চৌধুরী এনামুল খোঁজ খবর নিলেও আর কোনো দল বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কেউ কোনো খোঁজ খবর নেয়নি তার।

তারা আরও জানান, রনি’র বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতিতে মেরুদণ্ডের হাড়ের মধ্যে গেঁথে থাকা গুলি অস্ত্রোপচার করে বের করা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। 

এ জন্য আরও সময় লাগবে। তবে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে হয়ত অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা সম্ভব । কিন্তু একদিকে ধারদেনা, ঋণের বোঝা, অন্য দিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম বাপ-বেটা সম্পূর্ণ বেকার। বর্তমানে অভাবের সংসারে দু’বেলা দুমুঠো খাবার জোগান দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে রনির পরিবারকে।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ঢলনগর-হরিনারায়ণপুর গ্রামের শান্তা ইসলামের সাথে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে বিয়ে হয় রনি’র। তাদের সংসারে ফাহাদ ইসলাম নামে এক বছর বয়সী একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। দুই ভাইবোন, স্ত্রী সন্তান ও মা-বাবার ছয় সদস্যের সংসারে উপার্জনক্ষম ছিলেন রনি ও তার পিতা এনামুল হোসেন।

রনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল করে বেড়ানোর জন্য দুজনেরই আয়ের পথ বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শে বর্তমানে বাড়িতে অবস্থান করছেন রনি। পরিবারে আয়ের এখন কোনো উৎস নেই। আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির লোকজনের সহায়তায় আপাতত চলছে তাদের সংসার।

রনির পিতা এনামুল হোসেন বলেন, ‘আন্দোলনের শেষ দিন আমার সন্তান গুলিবিদ্ধ হয়। ছেলের পেছনে ঋণ করে, গ্রামের মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা তুলে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন আমি নিঃস্ব, রিক্ত। জানিনা আমার ছেলেটার চিকিৎসা শেষ করতে পারবো কিনা। 

আহত রনির মা নাজমা বেগম বলেন,‘পাঁচ মাস ধরে ঘুমাতে পারি না। রাত পোহালেই এনজিওর কিস্তি, এক বছরের নাতির দুধ কেনা, দু’বেলা দুমুঠো ভাত জুটবে কিনা এ চিন্তায় থাকি। গ্রামের মানুষ ভাবে, আমরা সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। অথচ রাতে খাবো ঘরে সে চাল নাই।’

আহত রনির স্ত্রী শান্তা ইসলাম বলেন,‘আমার স্বামী আজ পাঁচ মাস গুলিবিদ্ধ হয়ে আছে। শরীরে তাজা গুলির যন্ত্রণা নিয়ে সারাক্ষণ ছটফট করে। রাতে ঘুমাতে পারেনা।

স্ত্রী হয়ে এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারিনা। সরকারের নিকট জোর দাবি জানাই, তারা যেন তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। যাতে সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়। 

এ বিষয়ে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভির হাসান চৌধুরী বলেন, আহত রনির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কেউ আমাকে কিছু বলেওনি। তার

বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব অচিরেই করবো আশা রাখি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সাবেক সংসদ সদস্য রোকেয়া আনসারীর দাফন সম্পন্ন
ঢাকা-চট্টগ্রাম পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন উদ্বোধন আগামীকাল
খালেদা জিয়ার জন্মদিনে ফেনীতে বিএনপির মিলাদ ও দোয়া মাহফিল
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে খেলা নিয়ে সংঘর্ষ, নিহত ২
খুলনায় খালেদা জিয়ার ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিল
পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না : গোলাম পরওয়ার
খালেদা জিয়ার ৮১তম জন্মদিন উপলক্ষে শেরপুরে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত
রাজশাহীতে খালেদা জিয়ার জন্মদিনে যুবদল ও ছাত্রদলের দোয়া মহফিল
মাহেরিন চৌধুরীর আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল
আড়াই মাসে গাজায় ১৭৬০ জন নিহত : জাতিসংঘ
১০