বাসস
  ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:৫৪

স্ত্রীকে কোন কাজ করতে দেননি শহিদ আলাউদ্দিন, এখন স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান

শহিদ আলাউদ্দিন মল্লিক -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: আল-আমিন শাহরিয়ার 

ভোলা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): মো. আলাউদ্দিন মল্লিক। বয়স ৫৭ বছর। দীর্ঘ ১৬ থেকে ১৭ বছর ধরে ঢাকার মধ্য বাড্ডার বৈশাখী সরণী এলাকার একটি বাসায় দারোয়ানের কাজ করে আসছিলেন। এর আগে গ্রামের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের দক্ষিণ বালিয়া এলাকার তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। এতে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণ হয়ে যায় আলাউদ্দিনের। তাই সুখের আসায় গত ১৬ থেকে ১৭ বছর আগে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে গিয়ে সামান্য বেতনে একটি বাসায় দারোয়ানের চাকরি নেন। বাড়ির মালিকের দেয়া ওই ভবনের নিচতলায় একটি রুমে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন। সংসারে অভাবের কারণে বড় ছেলে আল আমিন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে কাজে যোগ দেয়। রাজ মিস্ত্রীসহ বিভিন্ন দিনমজুরি কাজ করে টাকা জোগাড় করে প্রইভেটকার চালানো শেখে আল আমিন। গত এক বছর ধরে ঢাকার একটি পত্রিকা অফিসে প্রাইভেটকার চালানোর চাকরি করছিল সে। বাবা ও ছেলের মাসিক বেতন দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি ছোট ছেলে ও মেয়ের পড়ালেখা চলছিল ভালোভাবেই।

গত এক মাস আগে বড় ছেলে আল আমিনকে বিয়ে করিয়েছেন বাবা আলাউদ্দিন। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে ঢাকার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আলাউদ্দিন মল্লিক শহিদ হন। পুলিশের ছোঁড়া বুলেটে নিমিষেই তার সুখের সংসার এলোমেলো হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর বড় ছেলে আল আমিন প্রাইভেটকার চালানো বাদ দিয়ে দারোয়ানির চাকুরিতে যোগ দেন। স্বামীর মৃত্যুতে সন্তানদের নিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসছেন এখন স্ত্রী রাজিয়া বেগম।

শহিদ আলাউদ্দিন মল্লিকের স্ত্রী রাজিয়া বেগম প্রতিদিনই স্বামীর জন্য আর্তবিলাপ করছেন। তিনি জানান, স্বামী ও বড় ছেলের মাসিক বেতন দিয়ে তাদের সংসার ভালোই চলছিলো। মেয়ে কুলছুম ভোলার চরফ্যাশন কলেজে ডিগ্রি ২য় বর্ষে পড়ে। আর ছোট ছেলে ইয়ামিন ২৬ পাড়ার কুরআনে হাফেজ। তার স্বামী আলাউদ্দিন নিজে কষ্ট করলেও তাকে দিয়ে জীবনে কোনো কাজ তো দূরের কথা বাজার থেকে কোনো কিছু কিনতেও পাঠায়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি নিজেই এখন অন্যের বাসায় কাজ করেন। নিজের থাকার বাসাটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে বড় ছেলেকে প্রাইভেটকার চালানো বাদ দিয়ে স্বামীর দারোয়ানিতে দিয়েছেন। বর্তমানে স্বামীর রেখে যাওয়া প্রায় চার লাখ টাকার মতো ঋণ রয়েছে। ছোট ছেলে মেয়ের পড়ালেখা ও মানুষের ঋণসহ সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাকে।

শহিদ আলাউদ্দিন মল্লিকের স্ত্রী রাজিয়া বেগম -ছবি : বাসস

আলাউদ্দিনের বড় ছেলে আল আমিন জানান, বাবা পছন্দ করে তাকে বিয়ে করিয়েছেন। এখনো বউ তুলে আনা হয়নি। গত ৫ আগস্ট বিকেলে তার বাবা আসরের নামাজ পড়তে বাসা থেকে বের হয়ে মসজিদে যায়। কিন্তু মাগরিবের নামাজের সময় হলেও তিনি বাসায় ফেরেননি। হঠাৎ সন্ধ্যার পর তার মোবাইল থেকে বাসার নম্বরে ফোন আসে যে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন। এ খবর পেয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চলে যান তারা। সেখানে গিয়ে দেখতে পান তার বাবার মাথায় বামপাশে গুলি লেগেছে। পরে অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা শেষে চিকিৎসক জানান, তাকে আইসিইউতে রাখতে হবে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউ খালি নেই। পরে সেখান থেকে রাতে শ্যামলী সিটি কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে রাখা হয়। পরদিন ৬ আগস্ট ভোর ৬টার দিকে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার পর ৬ তারিখই ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে গ্রামের বাড়িতে এনে রাতেই অন্যের জায়গায় দাফন করা হয়। 

আল আমিন আরো জানান, তার বাবার চিকিৎসা খরচসহ প্রায় চার লাখ টাকা দেনা রয়েছে। এছাড়াও ছোট ভাই ও বোন পড়ালেখা করে। বাবা মারা যাওয়ার পর নিজের প্রাইভেটকার চালানো চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বাবার চাকুরিতে যোগদেন। বর্তমানে খুব কষ্টে দিন কাটে তাদের। সংসারের খরচ জোগাতে তার মা এই বয়সে এসে অন্যের বাসায় কাজ করেন। তার বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের পাশাপাশি সরকারের কাছে তার এবং বোনের জন্য একটি চাকরির দাবি করেন আল আমিন।

তিনি জানান,সরকারিভাবে ভোলার জেলা প্রশাসন ও জামায়াতেইসলামীর পক্ষ থেকে কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন। কিন্তু তা দিয়ে বাবা’র ধারদেনা পরিশোধ হচ্ছেনা। 

এ বিষয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক মো: আজাদ জাহান বাসস’কে জানান, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকালেশহিদ ও আহত প্রতিটি পরিবার সরকার থেকে যথাযথ সম্মানসহ সার্বিক সহযোগিতা পাবে।