বাসস
  ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৯

পুলিশের গুলিতে চোখের পলকেই দৃষ্টি হারান ফটোগ্রাফার মাহবুব

আহত ফটোগ্রাফার মাহবুব আলম (২৯)

প্রতিবেদন: নুসরাত সুপ্তি 

নারায়ণগঞ্জ, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫(বাসস): শীতের সকালে ভোর হলেই মাহবুব বেরিয়ে পড়তো ছবি তুলতে। ঘুম থেকে উঠে রুমে গিয়ে দেখতাম ঘরে নাই। সেই ছেলেটা গত ছয় মাস ধরে অন্ধকার ঘরে, এখানেই তার রাতদিন, এখানেই শুয়ে শুয়ে কাটে তার সময়। আমার শান্তশিষ্ট, দায়িত্বশীল এই ছেলেটার জীবনটা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে। 

নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে কথাগুলো বলেছিলেন স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে দু’চোখের দৃষ্টি হারানো মাহবুব আলমের মা হালিমা বেগম। 

নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছেন মাহবুব। শখ করে ফটোগ্রাফি করতেন। সদর উপজেলার মিশনপাড়া এলাকায় পরিবার সমেত বসবাস তার। বাবা মশিউর রহমান (৬৫) ও মা হালিমা বেগমের (৫০) একমাত্র ছেলে মাহবুব আলম (২৯)। তাদের সামিয়া (২০) ও ফাতেমা (১৫) নামে আরো দুটি মেয়ে আছে। গত বছরের ১৮ জুলাই চাষাড়ায় পুলিশের ছোঁড়া ছররা গুলিতে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন মাহবুব। 

গত ১৮ জুলাই, সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জের বাতাসেও বইছিল আন্দোলনের দমকা হাওয়া। সেইদিনের ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করে মাহবুব আলম বলেন, ‘শুরু থেকে আমি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম না। কিন্তু আবু সাঈদকে হত্যার  পর আর ঘরে থাকতে পারিনি। একটা জলজ্যান্ত নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলল, এটা আর মেনে নিতে পারিনি।

চাষাড়ায় ওইদিন স্কুল কলেজসহ সকল বয়সী মানুষ আন্দোলন করছিল। এরমধ্যে হঠাৎ তখন প্রাইম হাসপাতালের সামনে একজন হিট স্ট্রোক করে, সেখানে গিয়ে ওরে ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ও ছাত্রদের মাঝে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে। আমি সেসময় কয়েকজনের সাথে হকার্স মার্কেটের ভেতরে ঢুকি। গুলির আওয়াজ বন্ধ হওয়ায় পুলিশ চলে গেছে কিনা সেটা দেখতে মাথাটা বের করেছিলাম, সেই মুহুর্তেই মুখে গুলি লাগে। চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। তখন এরপর আর চোখে কিছু দেখতে পাইনি।’ কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মাহবুব।

মাহবুব আলমের বাবা মশিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙা থানার রায়পাড়া এলাকায়। কয়েক যুগ ধরে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছেন তারা। ব্যবসা করছেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে। গত বছর হার্ট অ্যাটাকের পর মশিউর রহমান আগের মতো ব্যবসায়ে সময় দিতে পারেন না। 

নিজের ছেলের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে তিনি বলেন, মাহবুবের মুখমণ্ডলে প্রায় ৪০ টি ছররা গুলি লেগেছে। বাম চোখের ভেতর ৭ টি গুলি লাগে। মাথা থেকে চোখের সাথে সংযুক্ত নার্ভে গুলি লাগার ফলে মাহবুব কোন চোখেই দেখতে পায় না।

আহত মাহবুবের মা হালিমা বেগম বলেন, ‘ছেলের চোখ ঠিক করতে দেশের সব কয়টা ভালো ভালো হাসপাতালে গিয়েছি। বিদেশেও গিয়েছি। কিন্তু তেমন আশা পাইনি।

বৃহস্পতিবার মাহবুবের চোখে গুলি লাগে। তখন দেশের এমন একটা অবস্থা! মানুষ সরকারি হাসপাতাল সহ অনেক হাসপাতালেই কোন চিকিৎসা পায়নি। এতো এতো রোগী, কিন্তু শুক্রবার সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখছিল না, ছুটি কাটাচ্ছিল। চিকিৎসার অভাবে ছেলের চোখ মুখ ফুলে গিয়েছিল। আমাদের ভিসা থাকায় ওরে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। ২৩ দিন সেখানে চিকিৎসা করে কিছুটা সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসি। কিন্তু চোখে দেখতে পাওয়ার কোন আশা পাইনি সেখানে। এরপর থাইল্যান্ড যাই, সেখান থেকেও কোন রিস্ক নেননি তারা। দেশে ফেরার পর চোখের ভেতর কিছু রক্ত জমাট ছিল, চোখের পর্দা সরে গিয়েছিল, সেগুলো অপারেশন করে ঠিক করেছে।

কিন্তু এখনো চোখে ও মাথায় প্রায়ই তীব্র যন্ত্রণা হয় আমার ছেলের।’

হতাশায় অশ্রু ভেজা চোখ নিয়ে হালিমা বেগম বলেন, ‘ছেলের চিকিৎসায় প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু কোন আশা দেয়নি ডাক্তাররা। এদিকে আমার স্বামী গত রোজায় হার্ট অ্যাটাক করে। তার অপারেশন করার কথা ছিল জুলাই মাসে। কিন্তু এই ঘটনার পর সে ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। তার চিকিৎসার টাকাও ছেলের পেছনে খরচ করেছে। ওর ডান চোখে গুলি লাগেনি। এই চোখটা ঠিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে পরিবারের ছোট বড় অনেক কাজ আমার ছেলেটাই দেখত। ওনার অপারেশন ইন্ডিয়ায় করার কথা ছিল, ছেলেটা ছাড়া কিভাবে কি ব্যবস্থা করব আমি জানি না। তারে দ্রুত অপারেশন করে হার্টে রিং পরাতে বলছিল ডাক্তারেরা, কখন কি হয়, ভয় লাগে। এক রোজা গিয়ে আরেক রোজা চলে আসছে। আমার দুটো ছোট মেয়ে আছে। চিন্তায় আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার ছেলের জীবনডা কিভাবে যাবে, দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না- এটা বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি।

‘ফটোসেন্স’ নামক একটি পেজ ও গ্রুপের এডমিন ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী মাহবুব আলম। প্রকৃতির টানে ছুটে যেতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ক্যামেরাবন্দি করতেন সেই সব নান্দনিক দৃশ্য। নারায়ণগঞ্জের আলী আহম্মদ চুনকা পাঠাগারে করেছেন একাধিকবার চিত্র প্রদর্শনী। ফটোগ্রাফির কথা উঠতেই মাহবুব হাতাশার সুরে তার মাকে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে আর কথা বলো না, যা হওয়ার তো হয়েই গেছে’।

মাহবুব হতাশ হয়ে পড়লেও আশা দেখছেন তার বাবা মশিউর রহমান। তিনি বলেন, মাহবুবের চোখের চিকিৎসা আমেরিকায় আছে বলে জেনেছি। কিন্তু এর খরচ প্রচুর। সরকার সহায়তা করলে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে মাহবুবের চোখের আলো ফেরানো সম্ভব।

অনুদানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে মাহবুবকে এক লক্ষ টাকা দিয়েছে। আর জেলা প্রশাসক দিয়েছেন বিশ হাজার টাকা।’