প্রতিবেদন : নুসরাত সুপ্তি
নারায়ণগঞ্জ, ২৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ‘দেশের এই অবস্থায় আমি কেমনে ঘরে বসে থাকতে পারি? চিন্তা কইরো না। বেঁচে থাকলে গাজী, মরে গেলে শহীদ হব।’ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহীদ হওয়ার আগে স্ত্রী আলেয়াকে কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ তুহিন হোসেন।
শহীদ তুহিনের স্ত্রী আলেয়া বলেন, ‘ওনারে বলছিলাম, দেখ, সব জায়গায় ঝামেলা হচ্ছে। মানুষ মাইরা ফেলতাছে, তুমি যাইয়ো না। আমাগো একটা মাইয়া আছে।’
‘ওনি বলেছিলেন, আল্লাহ যার মরণ যেমনে লিখছে ওইভাবেই হইব। মাইয়ারে আল্লাহ দেখব। আর আজকে ভাইগো সাথে না দাড়াইলে, সারাজীবন আফসোস করা লাগব। গুলিতে আহত একজনরে বাঁচাইতে পারি, বাঁচাব। যদি একজন আন্দোলনকারীকে আন্দোলনে নিয়ে যাইতে সাহায্য করতে পারি, আমি করব।’
নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের উত্তর রসূলবাগ এলাকায় ভাড়া বাড়িতে দশ বছরবয়সী মেয়েকে নিয়ে বাস করেন শহীদ তুহিনের স্ত্রী আলেয়া। সেখানেই রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।
তুহিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছিলেন। তার শাহাদতের প্রায় বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখনও কান্না থামেনি তার পরিবারে।
করোনাকালে শহীদ তুহিনের বাবা শহীদুল ইসলাম মারা যান। এতে পরিবারে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। পারিবারিক দ্বন্দ্বে নিজেদের জায়গা-জমি হারিয়ে জীবিকার তাগিদে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। ব্যবসায় বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ে পরিবারটি।
পরবর্তীতে অটোরিকশা চালিয়ে রোজগারের দরজা খুলেন তুহিন। অটোরিকশা চালানোর রোজগারে বেশ ভালোই কাটছিল দিন। কিন্তু তুহিনের মৃত্যুর পর তার পরিবারের দিন যাচ্ছে আর্থিক টানাপোড়েনে।
স্ত্রী বলেন, ‘ওনি বাঁইচা থাকতে আমারে চাকরি করতে দেয় নাই। বলত, আমি বাইরে খাটনি করব, তুমি ঘরে আমার সন্তানটারে মানুষ করো। এখন সেই সন্তানটার জন্যই গার্মেন্টসে চাকরিতে লাগছি। ৯ হাজার টাকা বেতন পাই। ওভারটাইম হলে কিছু বেশি পাই। এগুলো দিয়েই কোনরকমে চলতাছি।’
মায়ের পাশে বসে বাবার কথা উঠতেই ডুকরে কেঁদে উঠেন শহীদ তুহিনের একমাত্র মেয়ে নুসরাত ফাতেমা। ফাতেমা বলেন, ‘আব্বু যাওয়ার সময় বলছিল, চিপস- চকলেট আনব। কিন্তু আব্বুরে যখন বাসায় আনছে, তখন আমার সাথে আর কোনো কথাই বলে নাই।’
আলেয়া মেয়ের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, মাইয়াটা ওর আব্বার কথা ভুলতেই পারে না। ওর আব্বারে স্বপ্নে দেইখা ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করে। বাবার কবরে গেলেও অনেক কান্না করে বলে, আব্বু আমার মজা লাগব না, তুমি চলে আসো।
অভাবের সংসারে পরিবারের চাহিদা মিটাতে দেশের বাইরে পাড়ি জমান তুহিনের মা ময়না বেগম। তিনি বলেন, ‘ঘরে টাকা পয়সার অভাব ছিল, এজন্য মালয়েশিয়া আসি। কিন্তু মহিলা মানুষ তো বেশি আয় নাই আমার এখানে।’
‘নিজের খরচ করে দেশে বেশি টাকা পাঠাতে পারি নাই। ছেলের মৃত্যুর কথা কথা শুনে দেশে চইলা আসি। আমার এক মেয়ে আর একটা ছেলেই ছিল। মেয়েটারে বিয়ে দিয়ে দিছি। ওয় নাই, এখন আমার কিছুই নাই।’
‘আন্দোলনের সময়ে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ায় শেষ বারের মতো ছেলেটার সাথে কথাও বলতে পারি নাই। শত শত বার ফোন দিছি এই ভেবে হয়তো এখন ফোনটা ঢুকবে।’
ময়না বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে যখন অটোরিকশা চালাতে চায়, তখন বলছিলাম তোর বংশে কেউ রিকশা চালায় নাই। ছেলে বলছিল, কাজে কেনো শরম নাই, আমি তো চুরি করব না।’
‘আমার ছেলেটায় অনেক সৎ আর সাহসী ছিল। মানুষের প্রাণ বাঁচাইতে গিয়ে আমার তুহিন মারা গেছে। ওয় আমার গর্ব, আমার অহংকার।’
আর্থিক সহায়তা প্রসঙ্গ উঠতেই কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘ছেলেই নাই আর্থিক সহায়তা দিয়েই বা কি হইবো।’ তবে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার কথা জানান তিনি।