জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েও শহীদের তালিকায় নাম নেই ভোলার সাহাবুদ্দিনের

বাসস
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:৪৪
ছবি : বাসস

আল-আমিন শাহরিয়ার

ভোলা, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েও শহীদের তালিকায় নাম নেই ভোলার সাহাবুদ্দিনের (৪১)। স্বৈরাচারী সরকারের পতনকালে দেশব্যাপী সহস্রাধিক ছাত্র জনতাসহ নানা পেশার মানুষ শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েক হাজার ব্যক্তি। ঐতিহাসিক রক্তস্নাত এই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকার রাজপথে সব চেয়ে বেশি শহীদ হয়েছেন, দ্বীপজেলা ভোলার নারী, পুরুষ শিশুসহ অর্ধশতাধিক মানুষ। সরকারের তালিকায় ভোলায় শহীদের সংখ্যা ৪৮ হলেও বেসরকারি হিসাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮ ব্যক্তি। 

জানা যায়, বিভিন্ন জটিলতা এবং নানা অজুহাতে জুলাই শহীদদের তালিকায় যাদের নাম এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি, চল্লিশোর্ধ্ব যুবক মো. সাহাবুদ্দিন তাদেরই একজন।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও সাহাবুদ্দিনের পরিবার এখনো জুলাই শহীদের তালিকায় তাদের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির নাম উঠাতে পারেননি।

শহীদের স্বীকৃতি পেতে সাহাবুদ্দিনের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানরা এখন স্থানীয় প্রশাসন ও এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ছুটোছুটি করছেন। 

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত সাহাবুদ্দিনের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা মো. আবুল কালামের ছেলে। সাহাবুদ্দিন পেশায় ছিলেন সিএনজি চালক। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাহাবুদ্দিনের বাবা মো. আবুল কালাম প্রায় ৪০ বছর পূর্বে পরিবার-পরিজনসহ ঢাকায় পাড়ি জমান। রাজধানীর শেরে বাংলা নগর এলাকায় একটি ভাতের হোটেল দেন এবং সেখানেই ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। ছেলে সাহাবুদ্দিন ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ঢাকাতেই তার বেড়ে ওঠা। সাহাবুদ্দিন ঢাকায় সিএনজি চালাতেন। 

স্ত্রী হালিমা বেগম জানান, ২ কন্যা সন্তান লামিয়া, সানজিদা, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। সন্তানের লেখা-পড়াসহ সাংসারিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় সিএনজি চালাতেন সাহাবুদ্দিন। 

পারিবারিক সূত্র জানায়, বাবার হোটেল ব্যবসা আর শাহাবুদ্দিনের উপার্জনের অর্থ থেকে কিছু টাকা জমিয়ে ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডে একটি ঘর নির্মাণ করেন তারা। 

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পুরো পরিবারে এক নিমিষেই নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা (২০২৪ এর ৫ আগস্ট) যেদিন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, সেদিন বিকেলেই জীবন প্রদীপ নিভে যায় শাহাবুদ্দিনের।

৫ আগস্ট বিকেলে অন্যান্যদের মত বিজয় মিছিলে যান শাহাবুদ্দিনও। কিন্তু বিধিবাম, ঢাকার শেরে বাংলা নগর এলাকায় বাসা থেকে বের হয়ে কিছুটা এগিয়ে চৌরাস্তার বিজয় মিছিলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের ছোড়া গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় সাহাবুদ্দিনের দেহ। রক্তে ভিজে যায় পিচঢালা রাজপথ। 

শাহবুদ্দিনের মৃত্যুর খবর শুনে তার ছোট বোন সাথী আক্তার ছুটে যান ঘটনাস্থলে। সেখান থেকে ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরবর্তীতে তাকে নিউরোসাইন্স হাসপাতালে নেয়া হলে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেদিন রাত ৮টার দিকে মৃত্যু হয় সাহাবুদ্দিনের। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকার রাজপথে ভোলা জেলার ৪৮ ব্যক্তি শহীদ হন। এর মধ্যে ভোলায় মো. জসিমউদদীন (৪৮) নামের একজন ছাড়া বাকি সবাই রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ হন। সেই সব শহীদদের (৪৮ জন) নাম সরকারি তালিকাভুক্ত হলেও অজ্ঞাত কারণে সাহাবুদ্দিনের নামটি এখনও তালিকাভুক্ত হয়নি। 

তথ্য অনুযায়ী, গোয়েন্দা রিপোর্টে সাহাবুদ্দিনের পরিবার সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক কথা উঠে আসায় এখনো বিষয়টির সুরাহা হয়নি। কিন্তু স্থানীয় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শাহাবুদ্দিনসহ তার পরিবার কখনোই কোন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল না।

শাহাবুদ্দিনের মা মনোয়ারা বেগম ছেলে হারানোর যন্ত্রণায় এখনো ডুকরে ডুকরে এখনো কাঁদছেন। তিনি বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা যেদিন দেশ থেইক্যা পালাইছে, হেই দিন বিকালে বিজয় মিছিলে গিয়ে আমার আদরের ধন সাহাবুদ্দিন পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়। তাই আমি সরকারের কাছে শাহাবুদ্দিনের নামটি শহীদের তালিকায় উঠানোর দাবি জানাই। পাশাপাশি আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেছেন শাহাবুদ্দিনের মা মনোয়ারা বেগম।

চরসামাইয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহে আলম, বশিরউদ্দিন ও এলাকার বন্ধুজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আ. শহিদ তালুকদার জানান, ২০২৪ ইং সালের ৫ আগস্ট সাহাবুদ্দিন পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন, এমন একটি খবর আসে আমাদের কাছে। 

তিনি বলেন, পরদিন সকাল ৮টার দিকে ঢাকা থেকে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়িতে। তখন স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি-সম্পাদকসহ শত শত লোকের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। 

সাহাবুদ্দিনের বোন ফাতেমা বেগম বলেন, বিজয় মিছিলে গিয়ে আমার বাবা ফিরে আসেন, কিন্তু ভাই সাহাবুদ্দিন ফিরে আসেনি। আমরা খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখি পুলিশের অনেকগুলো গুলি ভাইয়ের শরীর ও মাথায় লেগে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে এবং মাথার মগজ বের হয়ে পড়েছে। 

তিনি আরো বলেন, কিছু মানুষের হাছা-মিছা কথা শুনে, সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমার ভাইয়ের নামটি বাদ দেয়া হয়েছে। 

শহীদ শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী বিবি হালিমা বলেন, পরিবারে তিনিই আমাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। বর্তমান সরকারের কাছে আমার আবেদন, জুলাই আন্দোলনে নিহত স্বামীর নাম শহীদের তালিকাভুক্ত করার। যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।

এসময় তার কাছে রাজনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা তদন্ত করে দেখতে পারেন। আমার বিয়ের ১৭/১৮ বছর চলছে, তখন থেকে দেখেছি ওনারা ঢাকায় ব্যবসা করছেন। তারা কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না।

সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রথমে জামায়াতে ইসলাম থেকে ২ লাখ, তারপরে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকার একটি চেক এবং জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার একটি চেক পেয়েছি।

শহীদ শাহাবুদ্দিনের পিতা আবুল কালাম বলেন, আমার ছেলে শাহাবুদ্দিনের নামটা গেজেটভুক্ত করার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার ছেলের নামটা গেজেটভুক্ত হয় নাই।

জুলাই আন্দোলনে ভোলার ৪৮ জন শহীদের মধ্যে ৪৭ জনের নাম সরকারি গেজেটভুক্ত হলেও আমার ছেলের নামটি-ই গেজেটভুক্ত হয়নি। আমরা অসহায় পরিবার, সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমার ছেলের নামটা যেন গেজেটভুক্ত করা হয়। 

ভোলায় জুলাই আন্দোলনে শহীদদের নামের তালিকা বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য হচ্ছেন, সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসক। কি কারণে সাহাবুদ্দিনের নামটি সরকারি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না, সে ব্যাপারে কথা হয় ভোলার সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহানের সাথে। 

তিনি বাসস'কে বলেন, বিষয়টি পুনঃযাচাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আশাকরি শহীদ পরিবারটি ভালো ফল পাবেন। 

কথা হয় ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মনিরুল ইসলামের সাথে। বিষয়টি তার হাতে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ফের তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলে সে অনুযায়ী জেলায় জুলাই যোদ্ধা নির্ধারণ কমিটি পদক্ষেপ নিবেন।

এদিকে ভোলার সচেতন মহল মনে করছেন, সাহাবুদ্দিন যেহেতু জুলাই আন্দোলনে মারা গেছেন, সেহেতু তার নামটি সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা উচিৎ। তার পরিবারের প্রতি সরকার সহানুভূতির দৃষ্টি দিবে এটাই কামনা করছেন তারা। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএনসিসির উচ্ছেদ অভিযান
এক মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় কার্যকরের দাবি নাহিদের
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়কে স্বাগত জানালেন শহীদ ওয়াসিমের বাবা ও শান্তর মা
হাসিনার বিরুদ্ধে রায় প্রমাণ করে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়: প্রধান উপদেষ্টা
মালদ্বীপের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষায় বিশেষ কোটা
খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয় হবে না: গণঅধিকার পরিষদ
প্রভোস্ট আ্যাওয়ার্ড পেলেন ঢাবি অমর একুশে হলের ১৩ শিক্ষার্থী
লিওনাইস ৩য় গ্র্যান্ড মাস্টার্স দাবা প্রতিযোগিতার তৃতীয় রাউন্ড অনুষ্ঠিত
ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে এ রায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ : গণসংহতি আন্দোলন
জাঞ্জিবারকে উড়িয়ে দিয়েছে নেপাল
১০