‘হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে আমার আব্বারে মারছে’: শহীদ আব্দুর রহমানের ছেলে

বাসস
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ২০:৩১
শহীদ আব্দুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবেদন : নুসরাত সুপ্তি

নারায়ণগঞ্জ, ১৬ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ‘আমার আব্বার বয়স হইছে। উনি যদি আজকা অন্যভাবে মারা যাইতো, আমরা বিষয়টা মেনে নিতে পারতাম। হেলিকপ্টার থেকে পাখির মতো শিকার করে আমার আব্বারে মারছে। আব্বার বুকটা ঝাঁঝরা করে ফেলছে। আব্বার বুকটার কথা মনে উঠলেই আর সহ্য করতে পারি না।’ কথাগুলো বলেই অঝোরে কাঁদলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আব্দুর রহমানের (৬৫) ছেলে ফয়সাল।

২০২৪ সালের ২১ জুলাই সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জেও চলছিল কারফিউ। তবে কারফিউ না মেনেই ছাত্র-জনতা আন্দোলনে নেমে পড়ে। নারায়ণগঞ্জের ভুইগর এলাকার সিকদার পাম্পের সামনে তাদের সাথেই যুক্ত হন ষাটার্ধ্বো বৃদ্ধা আব্দুর রহমান। ছাত্রদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনে নামেন। কিন্তু আন্দোলনে নামার ঘণ্টখানেকের মধ্যেই হেলিকপ্টার থেকে একটি বুৃেলট এসে তাঁর বুকে বিঁধে, মহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আব্দুর রহমান।

পরিবারের সদস্যরা জানান, আব্দুর রহমান ভূইগড়ের পুরান বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। সেদিন বেলা ১১ টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডে  মিছিলে যোগদান করেন। মিছিলে যাওয়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তার মৃত্যুর খবর আসে।

আব্দুর রহমানের ছেলে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদককে বলেন, আব্বারে না করছিলাম, আব্বা বাইরের পরিস্থিতি ভালা না। তুমি কোথাও যাইও না। বাসায় আব্বারে রাইখা আমি একটু কাজে চাষাড়া আসছিলাম। রাস্তায় থাকা অবস্থায় একজনের কল আসে। রিসিভ করতেই বলা হলো, ‘আপনার আব্বার গায়ে গুলি লাগছে, হাসপাতালে নিতাছে।’ 

তিনি বলেন, ‘শুনে অবাক হইয়া গেলাম। মাত্রই তো আব্বারে বাসায় দেইখা আসলাম, আব্বায় খাইতেছিল, হাসাহাসি করতেছিল। পরে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রওনা হই। পথেই ফোন আসে হাসপাতালে যেন না যাই, আব্বায় আর নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘কথাটা আমি নিতে পারি নাই, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। সেসময় আমার সাথে আমার বন্ধু ছিল, সে আমারে বাসায় নিয়ে আসে। সেদিন বিকালে আব্বাকে জানাজা দিয়ে পরদিন আমার বাবার জন্মস্থান চাঁদপুর জেলার বালিয়া ইউনিয়নের দেওয়ানবাড়ি এলাকায় স্থানীয় কবরস্থানে নিয়ে দাফন করি।

আব্দুর রহমানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। তবে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তিনি তিনদশক ধরে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলায় বাস করতেন। জীবনযুদ্ধে ঠিকে থাকার জন্য অনেক কাজ করেছেন তিনি। অবশেষে ভূইগড়ের পুরান বাজার এলাকায় একটি ভাঙ্গারির দোকান দিয়েছিলেন।

বড় ছেলে ফয়সাল (৩৪) কাভার্ড ভ্যানের চালক। মেয়ে বৃষ্টিকে (২২) নিজ জেলা চাঁদপুরে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট রনি (২৫) ও মেহেদীকে (২০) নিয়ে বেশ সুখেই দিন অতিবাহিত করছিলেন আব্দুর রহমান। কিন্তু বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেওয়া বাবাকে আকস্মিকভাবে হারিয়ে তার সন্তানেরা হতবাক হয়ে পড়ে।

ফয়সাল বলেন, ‘আব্বায় অনেক আদর করে ছোট থেকে বড় করছে। নিজে কষ্ট করলেও আমাগো ভাই—বোনরে কখনো কষ্ট করতে দেয় নাই। একটু একটু করে আমাগো ব্যবসাটা একটা পর্যায়ে নিয়ে আসছিলাম। আজকা সব কিছু ছাইড়া চলে আসছি আব্বার কাছে। ওই মাটি আর ভালো লাগে না।’

তিনি জানান, অটোরিকশা চালিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেন ফয়সাল। নিজেদের ব্যবসা বিক্রি করে ছোট ভাই রনিকে কুয়েত পাঠিয়েছেন। বাবা হারানোর শোক এখনো কাটিয়ে উঠেনি এই পরিবার। বাবার কবরের পাশেই নতুন করে জীবন শুরু করেছেন।

দীর্ঘ দিনের জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন পঞ্চাশোর্ধ শাহানারা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি মাইয়ার কাছে গ্রামে আসছিলাম। সে আগের দিন ফোন করে বলছিল, আইসা পড়ো। আমিও ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি চলে যাবো। সেই আশা আর আমার পূরণ হইলো না। কী দোষ করছিল ফয়সালের আব্বায়? বুড়া একটা মানুষরে এইভাবে খুন করে? মানুষটার শরীর থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয় নাই। এই রক্তচোষাদের বিচার চাই আমি।’

সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন বলে জানান এই শহীদের পরিবার,  তবে সরকারের কাছে তার বাবার হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন তার সন্তানেরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ইলিশ সংরক্ষণে চাঁদপুরে কোস্ট গার্ডের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম
গুণগতমান ঠিক রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্নের নির্দেশ সেতু সচিবের
নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের অভিযান
শ্রমিক জাগরণের লক্ষ্যে ঢাকায় মহাসমাবেশ সফল করতে শিমুল বিশ্বাসের আহবান
ডিএমপিতে সেপ্টেম্বর মাসে সংক্ষিপ্ত বিচারে ২৫৭টি মামলা নিষ্পত্তি
দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে বাংলাদেশ ও তুরস্ক আলোচনা
শিক্ষার্থী হত্যা : সাবেক ধামরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাদ্দেছসহ পাঁচজন রিমান্ডে
লড়াই করে হারল বাংলাদেশ
ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার অভিনন্দন 
গ্রিস উপকূলে নৌকাডুবিতে ৪ অভিবাসী নিহত
১০