প্রতিবেদন : আবদুস সালাম আজাদ
চাঁদপুর, ১৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার গন্ধর্ব্যপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের মৈশামুড়া গ্রামের বড় বাড়ির আমিন মিয়ার ছেলে হান্নান(৩২) গেল বছর ১৮ জুলাই রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কাজ থেকে বাসায় ফেরার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জুলাই মারা যান।
ওই সময় হান্নানের স্ত্রী অন্তসত্তা ছিলেন। তিনি শহীদ হওয়ার দুই মাস পরে একমাত্র কন্যা সন্তান উম্মে হানির জন্ম হয়। এই নবজাতক দুনিয়ার আলো দেখলেও বাবার মুখ দেখবে না কোনোদিন। এতিম হয়ে জন্ম নেওয়া এই শিশুটি এখন নানা বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থেকে বেড়ে উঠছে।
শহীদ হান্নানের জন্ম ১৯৯২ সালের ৩০ জানুয়ারি। বাবা আমিন মিয়া (৯৫)। মা রাশিদা বেগম (৭৮)। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে হান্নান ছিলেন সবার ছোট। অপর ভাইয়েরা হলেন, বিল্লাল হোসেন (৫৫), ইমান হোসেন (৪৯), রফিক (৪৩) ও মান্নান (৪০)। একমাত্র বোন বোন বিউটি (৩৭)। তিনি বিবাহিত ও গৃহিণী। ভাইদের মধ্যে চারজনই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বেকারিতে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। শিক্ষা গ্রহণ করেন নিজ এলাকায় মৈশামূড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।
হান্নান ২০২৫ সালের ৬জানুয়ারি সামাজিকভাবে বিবি হাওয়া মুক্তাকে (২০) বিয়ে করেন। শ্বশুর ওমান প্রবাসী মো. স্বপন (৫২)। শাশুড়ি নাজমা বেগম (৪৫) গৃহিণী। গ্রামের বাড়ি একই উপজেলার কাশিমপুর উটনী গ্রামে। শ্বশুর স্বপন মিয়ার তিন মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে সুমাইয়া(২৫)ও বিবাহিত। ছোট মেয়ে নুসরাত (১৫) নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। একমাত্র ছেলে আহমেদ নাবিল (১০) মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
রফিক ও শহীদ হান্নান দুই ভাই মধ্য বাড্ডা পূর্বাঞ্চল ৯নম্বর রোড ‘আপনজন বেকারী’ নামে প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানে প্রথমে কাজ নেন রফিক। হান্নান গত ৪ বছর আগে ভাইয়ের একই পদে কাজে যুক্ত হন। বেকারির পাশেই একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় চারজন মিলে ভাড়া থাকতেন। সকলেই একই প্রতিষ্ঠানের কর্মী।
হান্নানের মৃত্যুর বিষয়ে বড় ভাই রফিক জানান, প্রতিদিন ভোরে আমার আগেই হান্নান কাজে গিয়ে মালপত্র গোছাতেন। ঘটনার দিন শুক্রবার (১৮ জুলাই) ভোর সাড়ে ৬টায় কাজে যান হান্নান। আমি এর আগেই গিয়ে কাজ শেষ করে বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ি। সকাল ১০টার দিকে হান্নানের রুমমেট রনি ফোন করে জানায় বাটারা থানার সামনের ফুট ওভারব্রিজের নিচে হান্নান গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে সাড়ে ১১টার দিকে প্রথমে কুর্মিটলা জেনারেল হসপিটালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসারত থাকা অবস্থায় ২০ জুলাই ভোর সাড়ে ৪টায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
রফিক আরো জানান, তার ভাইয়ের নাভির নিচে ডান পাশে গুলি লেগে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেরই তার মৃত্যু হয় বলে জানান চিকিৎসক। এরআগে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয় এবং কয়েক ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। গুলি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আমার ভাই খাবার দেয়ার জন্য খুবই হাহাকার করে। বারবার পানি চায় আর খাবার খেতে চায়। কিন্তু ভাই কে তো কিছুই করতে পারলাম না বলে আফসোস করেন তিনি।
রফিকের স্ত্রী জান্নাত বলেন, সে সবাইকে খুব সম্মান করতো, হান্নান খুবই দানশীল ব্যাক্তি ছিলেন। বিয়ের আগে তার আয়ের একটি অংশ গরীব মানুষকে দান করে দেন। যদিও তার বেতন ছিল মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকা।
বড় ভাই ইমান হোসেন বলেন, আমাপর ভাইকে ঢাকা মেডিকেলে আট ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হয়। পরে হাসপাতাল থেকে চাঁদপুরে তার লাশ নিয়ে আসা হয়। ওই রাতেই বাড়ির পাশের মসজিদের সামনে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, আমি প্রথমে ঢাকায় কাজ নেই। পরে অন্য ভাইদেরকে একই কাজে যুক্ত করি। আমার ভাই শহীদ হান্নান একটি বসতঘর করার খুবই স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পুরন হয়নি। তবে ভাই হত্যার বিচারে জন্য গত বছর ২৪ আগষ্ট ঢাকা সিএমএম আদালতে মামলার আবেদন করি। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ২ সেপ্টেম্বর বাটারা থানাকে মামলা রুজু করার নির্দেশ দেন। সেখানে পুলিশের আইজিপিসহ আট কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়। আমরা এই হত্যার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
হান্নানের বাবা আমিন মিয়া বলেন, তার ছেলের সাথে সব শেষ দেখা হয় গেল বছর ২৪ সালের কোরবানির ঈদের সময়। ছেলে ঢাকা থেকে গরু কিনে বাড়িতে নিয়ে আসে। সব ছেলেরা মিলেই কোরবারি পশু কাটাকাটি করি। সে ছোট হলেও সবচেয়ে বেশি আদরের সন্তান ছিল। আমার অসুস্থতা ও ওষুধের জন্য সবসময় খরচ দিতেন। সেই আদরের সন্তান হারিয়ে পেল্লাম।
ছেলের সাথে মা রাশিদা বেগমের সাথে সব শেষ কথা হয় ১৭ জুলাই। রাশেদা বেগম বলেন, ছেলে ফোন করে বাড়িতে রাস্তার মাটি কাটার বিষয়ে জানতে চান। একই সময় বাড়ির সবার খোঁজ-খবর নেন। আমাদের কোনো কিছু লাগবে কি না তাও জানতে চান। এখন আর খোঁজ নেয়ার কেউ রইল না। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাশিদা বেগম। এই বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা দুইজনই খুব অসুস্থ।
তিনি বলেন, ছেলে শহীদ হওয়ার পর তার স্ত্রী বাবা বাড়িতে থাকেন। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নানা রোগে আক্রান্ত। সরকারিভাবে সহায়তা আসলেও পাইনি। প্রতিমাসে দুইজনের ওষুধ খরচ লাগে ১০হাজার টাকার বেশি।
শহীদ হান্নানের স্ত্রী মুক্তা বলেন, ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সর্বশেষ কথা হয়। তখন আমাদের খোঁজ-খবর নেন। তখন তিনি বেকারি থেকে বাসায় যাচ্ছিলেন। আমাকে বলেছে বাসায় গিয়ে কথা বলবে। গুলির এই সংবাদ আমি আমার মেঝো জা জান্নাত থেকে জানতে পারি, যে আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমার স্বামীর মৃত্যুর আগেই জানতেন তার কন্যা সন্তান হবে। তিনি বলেছিলেন মেয়েকে যেন হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়ানো হয়। বড় হলে অবশ্যই মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়ানো হবে। স্বামীর মৃত্যুর পরে শ্বশুর পরিবারের কারো সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যে কারণে আমার সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমার সন্তানের পিতার মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যাক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করি।
শহীদ হান্নানের চাচা আব্দুল মতিন বলেন, ভাতিজা হান্নান খুবই সামাজিক ছিলেন। ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর পরে সরকারি কাগজপত্রসহ মামলার কাজে আমি সার্বিক সহযোগিতা করেছি। এই কাজে আমাদেরকে বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের হাজীগঞ্জের বিএনপি নেতা প্রকৌশলী মমিনুল হক।
তিনি আরো বলেন, এই পর্যন্ত শহীদ হান্নান পরিবার আর্থিক সহায়তা হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে প্রথম পর্বে ২০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বার দুই লাখ টাকা। জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ টাকা, বিএনপি নেতা প্রকৌশলী মমিনুল হকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা। হান্নানের স্ত্রী মুক্তা জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছে।