পাস্তায় বড় হওয়া প্রথা ভাঙা জনতার পোপ ফ্রান্সিস

বাসস
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:৪৬

ঢাকা, ২১ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : ৮৮ বছর বয়সে সোমবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা আর্জেন্টাইন ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ধর্মীয় নেতা—যিনি প্রচলিত প্রথা ভেঙে ক্যাথলিক গির্জায় এক মানবিক ও সহানুভূতিশীল চেতনার বার্তা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথাগত বিশ্বাস অক্ষুণ্ন রেখে তিনি চেষ্টা করেছিলেন গির্জাকে আরও জনমুখী, দরিদ্রপন্থী ও সহনশীল করে গড়ে তুলতে।

ভ্যাটিকান সিটি থেকে এএফপি জানায়, ‘জনতার পোপ’ নামে খ্যাত ফ্রান্সিস গির্জার গণ্ডির বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতেন। লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে উঠে আসা প্রথম পোপ তিনি, যিনি নিজেকে সবসময় ‘গরিবদের পক্ষে’ একজন কণ্ঠস্বর বলে দাবি করতেন—হোক সে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার জনগোষ্ঠী কিংবা বাস্তুচ্যুত অভিবাসী।

২০১৩ সালের মার্চে নির্বাচিত হয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। সেই শুরুতেই বলেছিলেন, ‘আমি চাই, গরিবদের জন্য গির্জা।’ নাম রেখেছিলেন ‘ফ্রান্সিস’, ১৩শ শতকের দরিদ্রপন্থী সাধক সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসির নামে।

সাদামাটা পোশাক, নিজে ফোন করে খোঁজ নেওয়া, বন্দীদের পা ধুয়ে চুমু খাওয়া—তার নেতারূপ ছিল এক অনাড়ম্বর মানবিকতা। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলি বলতেন, এমনকি হুইলচেয়ারে চড়েও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তিনি বারবার বলে গেছেন, অবসর নেওয়ার কথা কেবলমাত্র গুরুতর শারীরিক অক্ষমতার ক্ষেত্রেই বিবেচনা করা উচিত।

বিশ্বনেতাদের বিপক্ষে, উপেক্ষিতদের পাশে

দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বারবার উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের পরিকল্পনাকে বলেছিলেন ‘অখ্রিস্টীয়’। ইউরোপের শরণার্থী সংকটের সময় গ্রিস থেকে সিরীয় মুসলিম পরিবার নিয়ে ফেরত আসার মতো সাহসী বার্তা দিয়েছিলেন। একাধিকবার অস্ত্র ব্যবসায়ী ও যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনেতাদেরও সমালোচনা করেছেন, বলেছিলেন, আমরা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতরেই আছি।

বিশ্ব জলবায়ু সংকট নিয়ে তার বার্তাগুলোও ছিল কার্যকর। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে প্রভাবিত করেছিল তার ‘লাউদাতো সি’ নামক বিশ্বকবচ প্রেরণাপত্র।

ধর্মীয় সহনশীলতার পথে

পোপ ফ্রান্সিস বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। মস্কোর অর্থোডক্স প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলের সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ, কিংবা আল আজহারের সুন্নি শীর্ষ আলেম শায়খ আহমাদ আল-তাইয়েবের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি—সবই ছিল তার আন্তঃধর্মীয় সংলাপের অংশ।

যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনেও মধ্যস্থতা করেছিলেন তিনি। এমনকি চীনের সঙ্গে বিশপ নিয়োগ নিয়ে একটি বিতর্কিত চুক্তিও করেছিলেন, যদিও তা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।

সমকামী ও রূপান্তরিতদের পাশে থেকেও রক্ষণশীল

‘গে’ ক্যাথলিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কে বিচার করার?’—এই একটি উক্তি তার ভাবমূর্তিকে বদলে দিয়েছিল। তিনি সমকামী দম্পতিদের আশীর্বাদ, এমনকি রূপান্তরিতদের ব্যাপ্টিজম অনুমোদন করেছিলেন। তবে নারী পুরোহিতের অধিকার, গর্ভনিরোধ কিংবা সমলিঙ্গ বিবাহে গির্জার অবস্থান বদলায়নি। গর্ভপাতকে তিনি স্পষ্টভাবে ‘হত্যা’ বলেছেন।

নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্পষ্টতা, কিন্তু...

যাজকদের যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে দেখা করেছেন, দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলেছেন। পবিত্র আসনের নথি উন্মুক্ত করেছেন বেসামরিক আদালতের জন্য, রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করেছেন। তবুও, সমালোচকরা বলছেন—পোপ ফ্রান্সিস একটি এমন গির্জা রেখে গেলেন, যেটি এখনো অপরাধী যাজকদের রাষ্ট্রীয় বিচারের মুখোমুখি করতে দ্বিধাগ্রস্ত।

‘পাস্তায় বড় হওয়া’ পোপের গল্প

১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের ফ্লোরেস এলাকায় এক মধ্যবিত্ত ইতালিয়ান অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হোর্হে মারিও বেরগোলিও। পড়ালেখার পাশাপাশি মোজা কারখানায় কাজ, নাইটক্লাবের বাউন্সার হিসেবে দায়িত্ব, নাচ ও প্রেমের প্রতি আকর্ষণ—তার জীবন ছিল রঙিন।

১৭ বছর বয়সে ধর্মীয় আত্মমগ্নতা শুরু হয়। যাজক হিসেবে অভিষেক ১৯৬৯ সালে, মাত্র চার বছর পর আর্জেন্টিনায় জেসুইটদের প্রধান হন। তখন দেশের সেনাশাসনের ভেতরে বিভক্তির মুখোমুখি হন। সেসময় ‘দুই মুক্তিযোদ্ধা যাজককে’ ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে, যদিও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এরপর হয় নির্বাসন, একাকিত্ব, আত্মসংকট। আবার উঠে দাঁড়িয়ে হয়ে উঠলেন বুয়েনস আইরেসের ‘চর এলাকার বিশপ’। পরে হয়েছিলেন এমন এক পোপ, যিনি শুধু গির্জার নয়—বিশ্ব বিবেকের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

শেষ চুম্বকটি রেখে যান এই কথায়:

‘পোপ নির্বাচিত হওয়ার মুহূর্তে আমি এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করেছিলাম। সেটা কখনো আমাকে ছেড়ে যায়নি।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বিবাহের মাধ্যমে মানুষ পাপাচার থেকে বাঁচতে পারে : ধর্ম উপদেষ্টা
দাউদকান্দি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীর জমি ক্রোক, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
ডিসেম্বর ধরেই নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় বিএনপি : নজরুল ইসলাম খান
সুপ্রিম কোর্টে প্রাঙ্গণে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সমাবেশ
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সার্ভিস, ট্রেনিং এবং রিসার্চকে গুরুত্ব দিতে হবে : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা
নারী শ্রমিকের নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ে কমিশনের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ
নারীর শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ে কমিশনের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ
ময়মনসিংহে মাসব্যাপী এ্যাথলেটিক্স প্রশিক্ষণ শুরু
ময়মনসিংহে অনুর্ধ্ব-১৫ ফুটবল প্রশিক্ষণ শুরু
সোনার দামে নতুন রেকর্ড : প্রতি ট্রয় আউন্স ৩,৪০০ ডলার ছাড়িয়ে 
১০