ঢাকা, ২৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে নিজেদের বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতারা মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।
কুয়ালালামপুর থেকে এএফপি জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে বিশ্বব্যাপী, এমনকি মিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধেও কঠোর শুল্ক আরোপ করে বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।
যদিও পরবর্তীতে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৯০ দিনের জন্য এই শুল্ক বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেন, তবে এই ঘটনার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান তাদের বাণিজ্যিক অংশীদার বৈচিত্র্য আনতে উদ্যোগী হয়েছে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইবরাহিম সোমবার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক শৃঙ্খলার রূপান্তর ঘটছে।’
সোমবার রাতে জমকালো নৈশভোজের পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো আসিয়ান, চীন এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি)’র মধ্যে সম্মেলন শুরু হয়। জিসিসির সদস্য বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চোং জা ইয়ান বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে আসিয়ান একটি ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো উন্নত অর্থনীতির মধ্যে।
‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের অনিশ্চয়তা ও অননুমেয়তা বিবেচনায় নিয়ে আসিয়ান এখন বিকল্প খুঁজছে,’ বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘চীন ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে বিনিময় বাড়ানো এ বহুমুখীকরণেরই একটি অংশ।’
চলতি বছর আসিয়ানের ঘুর্ণায়মান সভাপতিত্বে থাকা মালয়েশিয়া সোমবার সংস্থাটির ৪৬তম শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধন করেছে এবং এই উদ্যোগের প্রধান চালিকাশক্তিও দেশটি।
মঙ্গলবার চীন যোগদানের আগেই আসিয়ান-জিসিসি সম্মেলন উদ্বোধন করে আনোয়ার বলেন, ‘স্থিতিশীলতার নোঙ্গর ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে এগিয়ে আসার সক্ষমতা ও দায়িত্ব উভয়ই আমাদের রয়েছে।’
‘সময়োপযোগী ও কৌশলগত’
ট্রাম্পের শুল্কনীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত চীনও এখন তার অন্যান্য বাজার শক্তিশালী করতে চাইছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোমবার জানায়, তারা ‘আসিয়ান ও জিসিসির সঙ্গে সহযোগিতা জোরদারের প্রত্যাশা করছে।’
চীন ও আসিয়ান ইতোমধ্যে একে অপরের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। শুধু এপ্রিলেই থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে চীনা রপ্তানি দ্বিগুণ হারে বেড়েছে—যার অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্রগামী পণ্যের রুট পরিবর্তন।
মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়ার খো ইং হুই বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী লি-র অংশগ্রহণ সময়োপযোগী এবং কৌশলগত। চীন এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে—বিশ্বের পশ্চিমা বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও নিজেদের নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে তুলে ধরতে।’
বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের পর সুইজারল্যান্ডে এক বৈঠকে ৯০ দিনের জন্য শুল্ক কমানোর চুক্তি হয়, তবুও চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক এখনও তুলনামূলক বেশি।
এএফপি দেখতে পাওয়া একটি খসড়া বিবৃতি অনুযায়ী, আসিয়ান ‘একতরফা শুল্ক ব্যবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ’ জানাবে।
তবে সংস্থাটি এ বছরের শুরুতে জানিয়েছিল, তারা পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে না। খো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে আসিয়ান সরাসরি চীনপন্থী অবস্থান নেবে না। লি’র উপস্থিতি জোরজবরদস্তির জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব ও বয়ান গঠনের কৌশলের অংশ।’
বিপজ্জনক জলসীমা
আসিয়ান ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পক্ষ নেওয়া এড়িয়ে চলে।
চীনের বিনিয়োগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চতুর্থ সর্বোচ্চ, যার আগে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
আনোয়ার সোমবার জানান, তিনি আসিয়ান-যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ সম্মেলনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। তবে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এখনও কোনো সাড়া মেলেনি।
চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো নতুন সমস্যা তৈরি করতে পারে, যদিও আনোয়ার সোমবার রাতে বলেন, ‘যা-ই বলা হোক, আমরা চীনের বন্ধু হিসেবেই এখানে আছি।’
এদিকে সোমবার ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে একটি ‘আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতা থাকা আচরণবিধি দ্রুত প্রণয়নের তাগিদ’ দেন।
এই জলসীমা নিয়ে চীনের সঙ্গে আসিয়ানভুক্ত পাঁচটি দেশের বিরোধ রয়েছে। বিশেষ করে চীন ও ফিলিপাইনের মধ্যে কয়েক মাস ধরে টানাপড়েন চলছে।
এনইউএস-এর চোং বলেন, ‘ম্যানিলা ও বেইজিংয়ের মধ্যকার উত্তেজনা এই ইস্যুগুলোকে অদৃশ্য হতে দেবে না। যদিও কিছু আসিয়ান রাষ্ট্র কেবল অর্থনৈতিক ইস্যুতেই মনোযোগ দিতে চায়।’