ঢাকা, ৪ জুন, ২০২৫ (বাসস) : কায়রোর প্রাণকেন্দ্রে একটি ছোট স্বাধীন সিনেমা হল বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মিশরের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা জগতের বাইরে নিজস্ব এক শিল্প জগৎ, এক শৈল্পিক পরিপ্রেক্ষিত গড়ে তুলেছে।
২০১১ সালের বিপ্লবোত্তর সৃজনশীল জোয়ারে যাত্রা শুরু করে ‘জাওইয়া’। আরবিতে এর অর্থ ‘দৃষ্টিকোণ’। স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর দেশজুড়ে সৃষ্টি হওয়া এক শিল্প-উদ্দীপনার আবহেই জন্ম হয় এই বিকল্পধারার সিনেমা হলটির।
প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ শাজলি এএফপিকে বলেন, ‘সেই সময়টায় চারপাশে এক ধরনের উদ্দীপনা ছিল, মানুষ সিনেমাসহ সব শিল্পমাধ্যমেই কিছু তৈরি করতে চাইছিল, একধরনের সৃজন-তৃষ্ণা কাজ করছিল।’
পরবর্তী সময়ে রাজধানী কায়রোর একের পর এক শিল্পকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলেও জাওইয়া টিকে গেছে। মিসর দীর্ঘদিন ধরে আরব বিশ্বের ‘হলিউড’ নামে পরিচিত হলেও মধ্য-২০ শতকের গৌরবময় সেই যুগের পর শিল্পটি মূলত কেবল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মাগেদ নাদের বলেন, ‘আমরা প্রায়ই বলি, আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের একটি বৃহৎ চলচ্চিত্র শিল্প রয়েছে। কিন্তু সত্যি হলো, এই শিল্পটা পুরোপুরি বাণিজ্যিক যুক্তিতে চলে। স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য এতে খুব কমই জায়গা আছে।’
তবে জাওইয়ার টিকে থাকার অন্যতম কারণ হলো এর পেছনে রয়েছে মিসর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মস নামের প্রতিষ্ঠানটি। শাজলির দাদা বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ইউসুফ শাহিন ১৯৭২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি এখনও চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা করে থাকে।
তরুণ অভিনেত্রী লুজাইন বলেন, ‘জাওইয়া সেই চলচ্চিত্রের জন্য, যেগুলো সাধারণ প্রেক্ষাগৃহে জায়গা পায় না।’ তিনি বলেন, ‘এটা আমার কাছে যেন নিজের ঘর,’ বড় হলে ঢোকার আগে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এএফপিকে বলেন ২৪ বছর বয়সী এই চলচ্চিত্রপ্রেমী।
২০১৪ সাল থেকে জাওইয়ার নিয়মিত প্রদর্শনসূচিতে রয়েছে দেশি-বিদেশি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি, প্রামাণ্যচিত্র এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছোট হলেও এই ধারাবাহিক আয়োজন একটি নিবেদিতপ্রাণ দর্শকগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে।
প্রতিবছরের বসন্তে অনুষ্ঠিত হয় তাদের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব। এটি তরুণ পরিচালকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মঞ্চ হয়ে উঠেছে, যেখানে তারা মূলধারার বাইরে নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করতে পারেন।
২৪ বছর বয়সী তরুণ বিজ্ঞাপনকর্মী মাইকেল স্যামুয়েল বলেন, ‘জাওইয়া আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি প্রদর্শন না করলে আমি নিজেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা ভাবতেই পারতাম না।’
তিনি বলেন, এই হলটাই তাঁর শিল্পীসত্তাকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। সিনেমা হলটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, ‘জাওইয়া আরও বেশি মানুষকে এসব চলচ্চিত্র বানাতে উৎসাহিত করেছে, কারণ অবশেষে তাদের তৈরি কাজগুলো দেখানোর মতো একটা জায়গা হয়েছে।’
স্বশিক্ষিত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা গারবেইয়ি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য যখন একটি লোকেশনের সন্ধান করছিলেন, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় জাওইয়া।
তিনি বলেন, ‘একটা স্টুডিও বা বাজেট কিছুই ছিল না। জাওইয়া আমাদের একদিন পুরো হলে ঢুকতে দেয় বিনামূল্যে,’ যাতে তিনি অন্তত ১ লাখ মিসরীয় পাউন্ড (প্রায় ২ হাজার ডলার) সাশ্রয় করেন।
ডাউনটাউন কায়রোর এমাদ আল-দিন সড়কে ঝলমল করা সাইনবোর্ড নিয়ে জাওইয়া যেন এই শতাব্দীর সেই সোনালি সময়ের উত্তরাধিকার, যেখানে একসময় ছিল মিশরের সবচেয়ে বড় থিয়েটার আর ক্যাবারে, আর যেখান থেকেই উঠে এসেছেন আরব বিশ্বের বহু খ্যাতিমান শিল্পী।
এই এলাকা এখন তেহরির স্কয়ারকে কেন্দ্র করে পুরনো ও নতুন এক সহাবস্থানের প্রতীক, যেখানে যুগপ্রাচীন থিয়েটার আর বার পাশে গড়ে উঠেছে আধুনিক কো-ওয়ার্কিং স্পেস আর গ্যালারি। তবে মাল্টিপ্লেক্সের আধিপত্যের ভেতরেও টিকে থাকলেও সেন্সরশিপ থেকে মুক্ত নয় জাওইয়া। প্রতিটি ছবিই এখানে প্রদর্শনের আগে রাষ্ট্রীয় সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন পেতে হয়।
প্রতিষ্ঠাতা শাজলি বলেন, ‘সময় যেতে যেতে আপনি অনুমান করতে শিখে যান, কী চলবে আর কী বাদ পড়বে।’ তবু এই কাটাছেঁড়াও নতুন নির্মাতাদের স্বপ্ন ও ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
শাজলি বললেন, ‘জাওইয়ার চারপাশেই রয়েছে প্রতিভা, প্রতিটি কোণায়,’ । ‘কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই প্রতিভার সমানপর্যায়ের সুযোগ কি আছে? সেটাই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়।’