ঢাকা, ১৩ জুন, ২০২৫ (বাসস) : তিউনিসিয়ার মরুপ্রতিম দক্ষিণাঞ্চলে উটের দুধই হয়ে উঠছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক। এই প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৩২ বছর বয়সী লতিফা ফ্রিফিতা, যিনি দুই বছর আগে মেদনিন অঞ্চলে চালু করেন দেশটির প্রথম এবং একমাত্র উটের দুধ পাস্তুরীকরণ কেন্দ্র।
এই প্রকল্পটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন করেছেন ৪৫ বছর বয়সী সিনিয়র বায়োকেমিস্ট আমেল সবুই। তিনি আরিড রিজিয়ন ইনস্টিটিউটে কর্মরত এবং এক বিশেষ পদ্ধতিতে পাস্তুরীকরণের পেটেন্ট পেয়েছেন, যা উটের দুধের পুষ্টিগুণ ও ওষুধি গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে এর সংরক্ষণক্ষমতা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
উটের দুধে গরুর দুধের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি আয়রন থাকে, এটি অ্যালার্জি-মুক্ত এবং গবেষণায় এটি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও প্রদাহ প্রশমনে কার্যকর বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
পাস্তুরীকরণ ছাড়া উটের দুধ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ প্রায় অসম্ভব। সেবুইয়ের গবেষণাগারে ১০ জন গবেষকের মধ্যে ৮ জনই নারী। তারা স্থানীয় হাসপাতালে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখিয়েছেন, উটের দুধ খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের অনেকে তাদের ওষুধের মাত্রা অর্ধেক পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পেরেছেন।
দক্ষিণ তিউনিসিয়ায় কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের অভাব থাকলেও উদ্যোক্তা ফ্রিফিতা বিশ্বাস করেন, স্থানীয়ভাবে অবহেলিত এই পণ্যের মধ্যেই রয়েছে পরিবর্তনের চাবিকাঠি। শুরুতে খামারিদের দুধ বিক্রিতে আগ্রহী করতে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, মাংসই অর্থ উপার্জনের প্রধান মাধ্যম।
ফ্রিফিতা বলেন, ‘তারা তখন বোঝেনি দুধ বিক্রির অর্থ কী। তারা দুধ নিজেরা খায় বা বিনা মূল্যে দিয়ে দেয়।’
তবে এখন, আস্থা ও সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ফ্রিফিতা আরও চুক্তি করার পরিকল্পনা করছেন।
২০১৬ সালেই ফ্রিফিতা তার উদ্যোগের নকশা আঁকতে শুরু করেন, কিন্তু ২০২৩ সালে ইনস্টিটিউটের সহায়তায় ‘চামেলেইত’ চালু করতে সক্ষম হন। তারা তাকে একটি ভবন ব্যবহার করতে দেয়।
দুই বছরের কন্যা সন্তানের মা ফ্রিফিতা বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই অঞ্চলেই বিনিয়োগ করব। স্বামীর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি না দিয়ে আমি এখানেই থাকলাম।’
মেদনিন থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে চেনচু এলাকায় অবস্থিত এই কেন্দ্র খামারিদের প্রশিক্ষণ দেয় কীভাবে যান্ত্রিক উপায়ে দুধ দোয়াতে হয়। যেখানে হাতে দুধ দোয়াতে দিনে গড়পড়তায় ২ লিটার পাওয়া যায়, যন্ত্রের মাধ্যমে তা বেড়ে ৭ লিটার হয়।
এই প্রকল্প এখন ফ্রিফিতা তার বড় বোন বেসমা সহ আরও একজন নারীর সঙ্গে মিলে পরিচালনা করছেন। তারা সপ্তাহে প্রায় ৫০০ লিটার পাস্তুরীকৃত দুধ উৎপাদন করেন এবং আগামী দুই বছরে তা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য রয়েছে।
এক লিটার দুধের দাম ১২ তিউনিসীয় দিনার (প্রায় ৪ ডলার)। যা খামারিদের দেওয়া দামের দ্বিগুণ। বাজারে সরাসরি চাহিদা অনুযায়ী ও কয়েকটি দোকানের মাধ্যমে বিক্রি হয় এই দুধ।
আমেল সবুই বলেন, দুধের স্বাস্থ্যগত উপকারিতার কথা ‘লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ায়’ এর চাহিদা বাড়ছে।
সবুই আরও জানান, ফ্রিফিতার প্রকল্প ছাড়াও উটের দুধ শুকিয়ে গুঁড়ো করে ওষুধ, স্বাস্থ্যকর খাদ্য বা সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার মতো সম্ভাবনাও রয়েছে, যদিও এ বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ইনস্টিটিউটটি ফ্রিফিতার প্রকল্পকে মডেল প্রকল্প হিসেবে দেখছে। এটি তিউনিসিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগিবার সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের দুর্গম ও অবহেলিত অঞ্চলগুলোতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোই এর উদ্দেশ্য।
প্রায় ৫ লাখ জনসংখ্যার মেদনিন অঞ্চলে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের হার যথাক্রমে ২২ ও ১৯ শতাংশ, যেখানে জাতীয় গড় ১৫ ও ১৬ শতাংশ। ফলে বহু তরুণ কাজের খোঁজে উপকূলীয় শহর বা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
ইনস্টিটিউটের ইনোভেশন বিভাগের প্রধান মুয়েজ লুহিশি বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য—মান যুক্ত পণ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। আমরা খামারিদের এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিচ্ছি যেন তারা এখানেই নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।’
২০১০ সাল থেকে ইনস্টিটিউটটি ৮০টি ব্যবসা উদ্যোগ শুরুতে সহায়তা করেছে, যার মাধ্যমে ৬০০ থেকে ১,০০০ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
২০২৫ সালের শেষ নাগাদ একটি বড় উটের দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র চালু হওয়ার কথা রয়েছে, যা যান্ত্রিক দুধ দোয়ানো প্রক্রিয়াকে আরও বিস্তৃত করবে।
লুহিশি আশা প্রকাশ করেন, এই উদ্যোগ দক্ষিণ তিউনিসিয়ার এক সময়ের অবহেলিত পণ্যকে ‘সাদা সোনা’তে রূপান্তর করবে।