খুদি বাড়ি : জলবায়ু সহনশীল ঘর নির্মাণই মেরিনা তাবাশ্যুমের স্বপ্ন

বাসস
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৫৯ আপডেট: : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:৫৫
স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম। ফাইল ছবি

সেলিনা সুলতানা

ঢাকা, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ (বাসস): নদী ভাঙনে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য জলবায়ু সহনশীল সাশ্রয়ী মূল্যের গ্রহণযোগ্য মোবাইল বাড়ি 'খুদি বাড়ি'র স্বপ্নদ্রষ্টা মেরিনা তাবাশ্যুম।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারপারসন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান জাদুঘরের প্রধান পরামর্শক ও স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে দ্বিতীয়বার আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার এই অর্জনকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সেলিনা সুলতান।

বাসস: দ্বিতীয়বারের মত আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পেয়েছেন, এজন্য আপনাকে অভিনন্দন।

মেরিনা তাবাশ্যুম: ধন্যবাদ।

বাসস: তিন দিনে একটি বাড়ি নির্মাণ এবং তিন ঘণ্টার মধ্যে স্থানান্তর করা যায়—এই বিষয়টি খুবই চমকপ্রদ। খুদি বাড়ির সম্পর্কে এ বিষয়ে কিছু বলুন। 

মেরিনা তাবাশ্যুম: এটা শুনতে নতুন মনে হলেও বিষয়টি আসলে সঠিক। আমরা রিসার্চ করছিলাম লোয়ার মেঘনা রিভার নিয়ে। অর্থাৎ চরাঞ্চলের মানুষ—যেমন ভৈরবী, হাইমচর। রিসার্চে ছিল—চর কেন হয় কেন ভাঙে, ভূগোলগত পরিবর্তন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি এবং এসবের প্রভাব চরাঞ্চলের মানুষের ওপর কীভাবে পড়ে। বাংলাদেশ ডাউনস্ট্রিম কান্ট্রি হওয়ায় ল্যান্ড হেরিটেজ কীভাবে প্রভাবিত হয় সেটিও দেখছিলাম। এসবের মধ্য থেকেই খুদি বাড়ির ধারণা আসে।

 

অনেকগুলো চরে গিয়ে দেখেছি মানুষ কীভাবে বসবাস করে। বন্যার সময় তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যেতে বাধ্য হয়। কারণ চরের কোন স্থায়িত্ব নেই। এই বাস্তবতায় খুদি বাড়ির পরিকল্পনা মাথায় আসে।

বাসস: কোন সময় চূড়ান্তভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবলেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: ২০২০ থেকে ২০২২ সময়টায় কনস্ট্রাকশন বন্ধ ছিল। তখন ভাবলাম চরের মানুষের জন্য কিছু করা যায় কিনা। কারণ তারা বেশি ইনভেস্ট করতে পারে না। এমন একটা ব্যবস্থা দরকার, যাতে তারা বন্যার সময়ও নিজেদের ঘরে থাকতে পারে। চর ভেঙে গেলে বা ডুবে গেলে উঁচু জায়গায় স্থানান্তরের সুযোগ থাকে। এসব লক্ষ্য নিয়েই খুদি বাড়ি প্রজেক্ট চালু করি।

বাসস: চলমান ঘর, অর্থাৎ প্রয়োজনের সঙ্গে নিয়ে চলা যায়—এটা বেশ নতুন ধারণা।

মেরিনা তাবাশ্যুম: হ্যাঁ, মুভেবল ঘর হলে চরাঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনে সরিয়ে নিতে পারবে। তাই এমন কাঠামো বানানোর কাজ শুরু করলাম যেটা সহজে দাঁড় করানো এবং খুলে ফেলা যায়।

বাসস: প্রথমে কোথায় এই প্রকল্প চালু করলেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: প্রথমে ঢাকাতেই চেষ্টা করি। পরে চরে পাঁচটা ঘর বানানো হয় স্থানীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করে। সুইস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের একটি ফান্ড পেয়ে সেই কাজ শুরু করি।

বাসস: দেশের কোন কোন জেলায় কাজ শুরু করেছেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: মেঘনার চর থেকে শুরু করে চাঁদপুর, সুনামগঞ্জ, জামালপুর ও কুড়িগ্রাম পর্যন্ত। কুড়িগ্রামের তিস্তা চরে গিয়ে দেখেছি, সেখানে মানুষ ভীষণ ঝুঁকিতে থাকে। এতটাই দুর্গম যে এনজিও কর্মীরাও যেতে পারে না। এসব জায়গায় খুদি বাড়ির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।

বাসস: কীভাবে এগিয়েছিলেন?

মেরিনা তাবাশ্যুম: ২০২১-২২ সময়ে পর্যবেক্ষণ করলাম। দু’বছরে জামালপুরে তিনবার বন্যা হয়। ৫০টি পরিবারের মধ্যে ২৩-২৫ পরিবারকে খুদি বাড়ি দিয়েছিলাম। তারা বন্যার সময় মাচায় আশ্রয় নেয়, রান্না করে এবং সংসার চালায়। কখনো ২ সপ্তাহ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত পানি থাকে। তখন নিচের ওয়াল খুলে দিয়ে পানি নামিয়ে দেয়। পরে পরিষ্কার করে আবার বসবাস করে। প্রয়োজনে ঘর ভেঙে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।

বাসস: খুদি বাড়ি তৈরির পদ্ধতি কি সহজলভ্য?

মেরিনা তাবাশ্যুম: খুব সহজ। কয়েকটা বাঁশ আর স্টিলের জয়েন্ট লাগে। এগুলো আলাদা করে বহন করা যায়, আবার জোড়া দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা যায়।

বাসস: নামটা কেন ‘খুদি বাড়ি’? সিলেকশন কীভাবে হয়?

মেরিনা তাবাশ্যুম: আগে নাম ছিল ‘খুদে বাড়ি’। আমাদের আর্কিটেক্ট আরমানের প্রস্তাবেই এখন ‘খুদি বাড়ি’। কমিউনিটি সিলেকশনে যুক্ত থাকে। আমরা ব্রোশিয়ার দেখাই, আলোচনা করি। ফ্রি দিলে ভ্যালু থাকে না, তাই পার্টনারশিপ রাখি। ঘরের মেঝে বা ভিটি পরিবারকে নিজ খরচে করতে হয়, আমরা কাঠামো সরবরাহ করি।

বাসস: কারা এর আওতায় আসে?

মেরিনা তাবাশ্যুম: চরের অপেক্ষাকৃত দুর্বল, বৃদ্ধ, বিধবা বা অসহায়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ২০-২৫ জনকে সিলেক্ট করা হয়। কেউ আগ্রহী হলে নিজের কিছু অর্থ দিলে আমরা সহায়তা করি।

বাসস: একটা খুদি বাড়ি বানাতে কত খরচ হয়?

মেরিনা তাবাশ্যুম: প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে লেবার, পরিবহনসহ সব খরচ থাকে। বর্ষাকাল ঘর বানানোর উপযোগী সময়। অনেকে রান্নাঘর, বারান্দা ও পশুপাখির ঘর ইত্যাদি নিজের মত করে যুক্ত করে।

বাসস: ‘ফেস’ সম্পর্কে বলুন।

মেরিনা তাবাশ্যুম: ফাউন্ডেশন ফর আর্কিটেকচার কমিউনিটি ইকুইটি (ফেস) খুদি বাড়ি প্রকল্প চালায়। ফেস জলবায়ু শরণার্থী, যাযাবর সম্প্রদায় ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে। এটি নন-প্রফিট। শুধু ঘর নয়, জীবিকা উন্নয়নেও কাজ করছি।

বাসস: এ পর্যন্ত কতগুলো খুদি বাড়ি নির্মাণ হয়েছে?

মেরিনা তাবাশ্যুম: প্রায় ১শ’টি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও কমিউনিটিভিত্তিক ঘর তৈরি করেছি। নারীরাও যুক্ত হয়েছেন।

বাসস: খুদি বাড়ির প্ল্যানটা কোথা থেকে এসেছে? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

মেরিনা তাবাশ্যুম: এটা আমার মাথা থেকেই এসেছে। পরে সবাই মিলে রূপ দিয়েছি। এখনও চলমান। প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ভবিষ্যতে দক্ষিণের নদী ও চরগুলোতেও কাজ করব।

বাসস: কম খরচে খুদি বাড়ির মত এমন কাজে সরকারের কোন অংশগ্রহণ ছিল কি? 

মেরিনা-তাবাশ্যুুম: গত সরকারের সময়ে সরকার চালিত 'আশ্রায়ন প্রকল্প ' ছিল। আমরা চেষ্টা করেছিলাম সেটির সঙ্গে খুদি বাড়ি প্রকল্প মার্চ করে দিতে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের থেকে সেসময় কয়েকজন কর্মকর্তা আমাদের প্রকল্পগুলো পরিদর্শনও করেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আশির দশকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা  ড. মুহাম্মদ  ইউনূসের ‘গ্রামীন হাউজিং’ নামে একটি প্রকল্প চলমান ছিল। সেটিও আগা খান অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। প্রকল্পটিতে টিন আর খুঁটি দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হতো। সেসময় ওই পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল দেশজুড়ে। সময় বদলেছে। চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। সময়ের ব্যবধানে ছোট ঘরের বড় অবদান এই খুদি বাড়ি।

বাসস: ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের ‘সন’ পদক পেয়েছিলেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।

মেরিনা তাবাশ্যুম: বিদেশে এটাকে ‘হিউম্যানিটারিয়ান’ উদ্যোগ হিসেবে দেখা হয়। আমি এটাকে ভার্নাকুলার আর্কিটেকচার মনে করি। গ্রামীণ ঘর যেমন সময়ের সঙ্গে বদলায়, খুদি বাড়িও তেমনি মানিয়ে চলে। ক্লাইমেট ক্রাইসিসের জন্য অভিযোজন জরুরি। মানুষকে সচেতন করতে হবে।

বাসস: ২০১৬ সালে আপনার নকশাকৃত মসজিদের জন্য আগা খান পুরস্কার পেয়েছিলেন।

মেরিনা তাবাশ্যুম: ঢাকার দক্ষিণখানে আমার নানী মসজিদের জন্য জায়গা দেন। আমি ডিজাইন করি। এর নাম বায়তুর রউফ মসজিদ। আলো-ছায়ার কারুকলার জন্যই সেটা পুরস্কৃত হয়েছিল।

বাসস: এ বছর বিজয়ী হিসেবে সাতটি প্রকল্পের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর কাজাখস্তানের বিশকেকে পুরস্কার দেওয়া হবে।

মেরিনা তাবাশ্যুম: এটা কেবল আমার একার পুরস্কার নয়, টিমওয়ার্কের ফল। আমাদের গ্রান্টদাতা, কমিউনিটি, ফেস—সবার অবদান রয়েছে।

বাসস: সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মেরিনা তাবাশ্যুম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় ঢাবির রোকেয়া হলে ছাত্রদলের দোয়া মাহফিল
ইউক্রেন ইস্যুতে ট্রাম্পের বক্তব্য রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ : ক্রেমলিন
জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হাতপাখার বিজয় নিশ্চিত করতে হবে : রেজাউল করীম
টিআইবি’র দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতার ফল ঘোষণা 
রায়পুরার সংঘাত বন্ধে কম্বিং অপারেশন করা হবে: স্বরাষ্ট উপদেষ্টা
বাংলা একাডেমিতে ‘বিজয় বইমেলা’ শুরু 
লালমনিরহাটে জন্মান্ধ হাফেজা খাদিজার পাশে বিএনপি নেতা দুলু
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতীতের মত দলাদলি চলবে না : ড. আমানুল্লাহ
ফ্রাঙ্কো-জার্মান মানবাধিকার পুরস্কার পেলেন সুমাইয়া ইসলাম
ডিএমপির নভেম্বরের মাসিক অপরাধ সভায় শ্রেষ্ঠ যারা
১০