
\ বরুণ কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ \
ঢাকা, ১২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : আমাদের সমাজে বর্তমানে আত্মহত্যা একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যথাযথ সচেতনতা ও মানসিক সহায়তা দিয়ে আত্মহত্যা বলতে গেলে পুরোপুরিই ঠেকানো যায়। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো, মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অবহিত করা এবং সংকটে থাকা ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে এই প্রবণতা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বাসসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘শরীরে যেমন অসুখ হয়, তেমনি মনেরও অসুখ হতে পারে। তাই মনকে অবহেলা করা উচিত নয়। যে কোন সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পরিবারের কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগলে তাকে অবহেলা না করে যত্ন ও সহায়তা দিতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। সবাই সচেতন হলে এই মৃত্যুগুলো অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।’
ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসা এখন অনেক সহজলভ্য। একজন মানসিক রোগী যেন ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত না হয়, সে জন্য পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আত্মহত্যা প্রতিরোধে সাংবাদিকদেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। জনগণের সামনে আত্মহত্যার ক্ষতিকর দিকগুলো এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে মানসিকভাবে বিপন্ন যে কেউ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে না পড়েন।’
তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার পর দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় আত্মহত্যা করে। ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী মেয়েদের এবং ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামে এই হার বেশি দেখা যায়, যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ বেকার। এদের বেশিরভাগ গলায় ফাঁস দিয়ে কিংবা কীটনাশক পান করে আত্মহত্যাকে প্রধান উপায় হিসেবে বেছে নেন।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক আরো বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে পারিবারিক সচেতনতা খুবই জরুরি। অনেক বাবা-মা’ই জানেন না বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কি রকম আচরণ করা উচিত। তাছাড়া পারিবারিক কলহ, বাবা-মায়ের ঝগড়া-বিবাদ, সন্তানকে হেয় করা, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা, এসব বিষয় কিশোর-কিশোরীদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে তারা নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। একটু খেয়াল করলেই পরিবারের মানুষ কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এসব বিষয় বুঝতে পারেন। এ সময় তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করলে, পাশে থাকলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।’
দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা কেন বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশে ভয়াবহ হারে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যার প্রধান কারণগুলো হলো অতিরিক্ত মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার, অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, পরিবার ও কর্মস্থলে অবহেলা, সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা, যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া, মাদকাসক্তি এবং প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরতা। ব্যক্তিজীবনের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, নানামুখী চাপ, কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, অপ্রাপ্তি, লোভ, বিচারহীনতা মানুষকে হতাশায় ডুবিয়ে মানসিক রোগীতে পরিণত করছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে মানসিক রোগী বাড়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে এই কারণগুলো।’
মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় দেশে বিশেষায়িত হাসাপাতালের প্রয়োজন আছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানসিক রোগের চিকিৎসা সাধারণত দুইভাবে করা হয়। ওষুধের মাধ্যমে এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে। সাইকোথেরাপি সব রোগীর জন্য প্রয়োজন। তবে আমরা ওষুধের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আশার কথা হলো, মানসিক রোগের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ওষুধই এখন বাংলাদেশে তৈরি হয় এবং এগুলোর দামও খুব বেশি নয়।’
ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো এখনো খুব সীমিত। মানসিক রোগের চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সংকট রয়েছে। আমাদের দেশে প্রতি পাঁচজনের একজন কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছেন। মোট জনসংখ্যার হিসেবে অন্তত ৩ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এত বড় জনসংখ্যার জন্য বর্তমানে ঢাকায় একটি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট এবং পাবনায় একটি কেন্দ্র রয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ১ হাজার বেড খুবই সামান্য। তাই মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় দেশের অন্যান্য বিভাগে উন্নত মানের হাসপাতাল করা যেতে পারে।’
শিশুদের প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়ে এই পরিচালক বলেন, ‘শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমা টানতে হবে। এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত তদারকি করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই। কারণ তারাও স্বতন্ত্র মানুষ। তাদের নিজস্ব মানসিক বিকাশ ও চাপ সামলানোর ক্ষমতা আছে। শিশুদের মানসিক চাপ সাধারণত তাদের আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে বোঝা যায়। যেমন হঠাৎ স্কুলে না যেতে চাওয়া, বন্ধুদের থেকে দূরে থাকা, ঘুমের সমস্যা বা অতিরিক্ত রাগ-আবেগের প্রকাশ।’
মানসিক রোগ এড়াতে চাপমুক্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সবসময় চাপমুক্ত থাকতে অতিরিক্ত ডিভাইসের ব্যবহার কমাতে হবে। সময়মতো ঘুমাতে হবে। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে।’
এছাড়া শিশুদের মানসিক বিকাশে বাইরে খেলাধুলা, সৃজনশীল কাজ এবং পরিবারের সাথে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ বাড়াতে অভিভাবকদের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানান তিনি।