
বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রঊফ
ঢাকা, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): পরিবেশ দূষণের কারণে চোখের অ্যালার্জি এবং সেই অ্যালার্জির ড্রপ ব্যবহারে ভুলের ফলে গ্লুকোমার মত জটিল রোগ বাড়ছে। অন্যদিকে শিশুদের ইনডোর বা ঘরকুনো জীবনযাপনের কারণে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে মায়োপিয়া (ক্ষীণদৃষ্টি)। এমন নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশে চোখের চিকিৎসা এখন অনেক উন্নত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ডা. কাজী মো. মনিরুজ্জামান বাসসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে কয়েকটি বিষয় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, চক্ষু চিকিৎসা তার মধ্যে একটি। দেশে চোখের সাব-স্পেশালিটিগুলোর পাশাপাশি অনেকগুলো বিশ্বমানের প্রাইভেট চক্ষু হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও এটা ছিল না। আগে চোখের ডাক্তারদের অধিকাংশই চশমার দোকানে বসতেন, যেখানে কোন ভালো চিকিৎসা সুবিধা ছিল না। এখন দেশে চোখের সব অত্যাধুনিক চিকিৎসা হওয়ার কারণে বিদেশে যাওয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
ডা. কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আগে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকে রেটিনা, গ্লুকোমা, কর্নিয়া, ছানিসহ প্রায় সব ধরনের রোগের চিকিৎসা করতে হতো। কিন্তু একজন চিকিৎসকের পক্ষে সব বিষয়ে সমানভাবে পারদর্শী হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে রোগীরা বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হতেন। এখন যেহেতু অনেকগুলো সাব-স্পেশালিটি তৈরি হয়েছে, তাই রোগীরা অনেক ভালো চিকিৎসা পাচ্ছেন। যেমন, একজন চিকিৎসক যখন দেখেন রোগীর রেটিনা স্পেশালিস্টের কাছে যাওয়া প্রয়োজন, তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে সেখানে রেফার করে দেন। আবার রেটিনা স্পেশালিস্ট যখন দেখেন রোগীর গ্লুকোমা আছে, তিনি সেই স্পেশালিস্টের কাছে পাঠান। মূলত এই সমন্বিত ব্যবস্থার কারণে চোখের চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে গেছে।’
দেশে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষের চোখের সমস্যা বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইদানিং বাচ্চাদের যেসব চোখের সমস্যা বেশি হচ্ছে, তার মধ্যে মায়োপিয়া বা চশমাজনিত সমস্যা অন্যতম। এর কারণ তাদের জীবনযাত্রা। আমাদের বাচ্চারা এখন কাছে দেখার কাজগুলো বেশি করছে। এরা সারাক্ষণ রুমের ভেতর থাকে, তাদের আউটডোর অ্যাক্টিভিটি কম। খেলাধুলা বলতে মোবাইলে গেমকে খেলা বোঝে। গাড়িতে করে স্কুলে যায়, সেখানে গিয়েই ক্লাসরুমের ভিতর ঢুকে যায়। ফলে তারা রুমের ভেতরেই বন্দি থাকছে।’
তিনি মানবদেহের ন্যাচারাল স্ট্রাকচার ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমরা যে কাজটা বেশি পরিমাণে করি, সেই কাজটাতে বেশি পারদর্শী হই। এটা ন্যাচারালি ঘটে এবং আমাদের বডি সেভাবেই সুগঠিত হয়। ফলে যারা দীর্ঘ সময় কাছে থেকে ফোন বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করছেন, তাদের চোখও কাছে দেখার জন্য ওইভাবে তৈরি হচ্ছে। এতে করে ওই চোখটা মাইনাস পাওয়ারের দিকে শিফট করছে, অর্থাৎ মায়োপিয়া হচ্ছে। এর প্রমাণ হলো, গ্রামের যেসব বাচ্চারা বাইরে খেলাধুলা করে, উঠোনে দৌড়ায়, তাদের চশমা লাগে না।’
বড়দের চোখের রোগ বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনি পরিবেশ দূষণকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বাইরে প্রচুর ধুলাবালি, এই ধুলাগুলো চোখে গিয়ে অ্যালার্জেন (অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান) হিসেবে কাজ করে। এ থেকে চোখে অ্যালার্জি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অ্যালার্জি সারাতে যে ড্রপ দেওয়া হচ্ছে, তা রোগীরা দীর্ঘদিন ব্যবহার করছেন। ডাক্তার হয়ত এক মাস ব্যবহার করতে বললেন, কিন্তু রোগীরা ভালো বোধ করায় ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে নিজেরাই সেই ড্রপ কিনে ব্যবহার করতে থাকেন। ফলে ‘স্টেরয়েড ইনডিউসড গ্লুকোমা’ এবং ‘স্টেরয়েড ইনডিউসড ক্যাটারাক্ট’ (ছানি)-এর মতো রোগ হয়। অর্থাৎ, ধুলাবালির জন্য তো অ্যালার্জি হচ্ছেই, আবার রোগীর ভুল চিকিৎসায় আরও নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’
এ সময় দেশের জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে চক্ষু চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর কথাও জানান ঢামেকের এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় অনেকগুলো চক্ষু হাসপাতাল গড়ে উঠেছে, চট্টগ্রাম বিভাগসহ সব বড় শহরেও মোটামুটি ভালোমানের হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চক্ষু চিকিৎসা সেবা এখনও পর্যাপ্ত নয়। সেখানে চিকিৎসকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। ফলে এখনো প্রচুর রোগী ঢাকা কিংবা অন্যান্য বিভাগীয় শহরে যাচ্ছেন। যেটা আমাদের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ। তাই আমি মনে করি জেলা ও উপজেলা শহরে চক্ষু চিকিৎসকের পদায়ন প্রয়োজন।’
চক্ষু রোগীদের চিকিৎসায় দেশে বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন আছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের যে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট রয়েছে, সেটা মাত্র ২৫০ বেডের হাসপাতাল। তারপরও সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ বিষয়ে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিকে অন্তত ৫শ’ বেডের করা উচিত। এছাড়াও বিভাগীয় পর্যায়ে এ ধরনের ইনস্টিটিউট থাকলে খুবই ভালো হবে। আর যদি তা করা সম্ভব না হয়, তাহলে কমপক্ষে মেডিকেল কলেজগুলোতে বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসকের সংখ্যা এবং ফ্যাসিলিটি বাড়িয়ে আপাতত ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।’
শিশুসহ সকল বয়সি মানুষের চক্ষু রোগ প্রতিরোধে বেশ কিছু পরামর্শ দেন ডা. কাজী মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আউটডোর অ্যাক্টিভিটির জন্য তাদেরকে সুযোগ দিতে হবে। সারাক্ষণ রুমের মধ্যে বন্দি বা মোবাইল দিয়ে রাখা যাবে না। দিনে কমপক্ষে একবার-দুবার হলেও তাদেরকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়া উচিত। আর বড়দের ক্ষেত্রে, যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং এর ডিউরেশন যদি কমপক্ষে ১০ বছর হয়, তাহলে প্রতি এক থেকে দুই বছর পর তাকে অবশ্যই চক্ষু চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। দেখাতে হবে রেটিনায় কোন পরিবর্তন আছে কিনা। কারণ, ডায়াবেটিসের কারণে যেমন কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি রেটিনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
ডা. মনিরুজ্জামান আরও বলেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাত জেগে মোবাইল বা এ জাতীয় ডিভাইস ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এতে শুধু চোখ নয়, পুরো শরীরেরও ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের শরীরে ঘুমের একটি স্বাভাবিক ছন্দ আছে, যাকে ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ বলা হয়। সাধারণত রাত ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে শরীরে ঘুমের হরমোন সবচেয়ে বেশি নিঃসৃত হয়। এই সময়টা পেরিয়ে গেলে ঘুমের ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। এতে মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, এমনকি মনোযোগে ঘাটতি দেখা দেয়। তাই নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ঘুমানোর আগে মোবাইল ব্যবহার না করাই সবচেয়ে ভালো।
সবশেষে চোখের যত্ন ও সুরক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চোখ আমাদের অমূল্য অঙ্গ। একটু যত্ন নিলেই অনেক সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়। নিয়মিত ঘুম, কম ডিভাইস ব্যবহার, বাইরে পর্যাপ্ত সময় কাটানো এবং বছরে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা-এগুলোই চোখকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখার সহজ উপায়।’