\ দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ \
কুমিল্লা, ২৯ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) সহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২৯ জুলাই সোমবার নতুন মাত্রা পায়। পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বাধা, হামলা ও হেনস্তার শিকার হন। ওই দিন দুপুরে মিছিলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হন কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থী।
সোমবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত কুবির প্রধান ফটক ও সংলগ্ন কোটবাড়ি এলাকা, ব্লু ওয়াটার পার্ক রোড ও বিশ্বরোড এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করে ।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সাথে আলাপে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে চাইলে বহিরাগত যুবক এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায় এবং আন্দোলনে যোগদানে বাধা দেয়।
২৯ জুলাই দুপুর ২টার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটসংলগ্ন এলাকাসহ আশপাশের রাস্তায় হেলমেট পরা যুবকদের দেখা যায়। তাদের হাতে ছিল লাঠি, গাছের ডাল, লোহার রড ও স্ট্যাম্প। তারা যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের পরিচয় যাচাই করতে থাকে। আন্দোলনে যোগদানকারী সন্দেহে অনেক শিক্ষার্থীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয় এবং কয়েকজনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। অনেককে বাধ্যতামূলকভাবে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী তাহসিন আব্দুল্লাহ সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি সিএনজিতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম। গেটের কাছে এসে কয়েকজন আমাকে টেনে নামিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করে। আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেয় এবং হাতে থাকা বই ছিঁড়ে ফেলে।’
তিনি জানান, হামলাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও বহিরাগত যুবলীগের সস্ত্রাসী ছিল।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী একা তালুকদার বলেন, ‘আমি একা ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলাম। গেটের কাছে কয়েকজন যুবক আমার ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করে এবং বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। পরে কয়েকজন সিনিয়র ভাই এগিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করেন।’
এদিন বেলা ৩টার দিকে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম নাইম (১৮) গুলিবিদ্ধ হন। তিনি বরুড়া উপজেলার মহেশপুর গ্রামের বাসিন্দা।
বাসসের সাথে আলাপকালে নাইম বলেন, ‘২৯ জুলাই ২০২৪। আমি টিউশন শেষ করে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে দৌড় শুরু করি। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ পা অবশ হয়ে পড়ে যাই। এরপর আর কিছু মনে নেই। পরে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে।’
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দুপুর ২টায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাধার মুখে সময় পিছিয়ে বিকেল ৩টায় মিছিল শুরু হয়। পথে পথে প্রতিরোধের কারণে অনেক শিক্ষার্থী মিছিলে যোগ দিতে না পারলেও বিক্ষোভ মিছিলটি নির্ধারিত রুটে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা হয়।
মিছিলটি কুবির প্রধান ফটক থেকে শুরু হয়ে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে ঘুরে আবার প্রধান ফটকে এসে শেষ হয়। মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা ‘শিক্ষা-ছাত্রলীগ, একসঙ্গে চলবে না’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে’, ‘তুমি কে, আমি কে? সমন্বয়ক, সমন্বয়ক’-এই ধরনের স্লোগানে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত করে তোলে।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নিলেও পুরো ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা ছিল অনেকটাই নীরব। হামলা ও গুলিবর্ষণের সময় প্রশাসনের কেউ সরাসরি মাঠে না থাকায় ক্ষুব্ধ হয় শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কুবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক মোহাম্মদ সাকিব হোসাইন বাসসকে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী বাধার সম্মুখীন হন, হেনস্তার শিকার হন। এসব বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও তারা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বরং তাদের নিরবতা হামলাকারীদের উৎসাহ দিয়েছে।’
এদিকে ঘটনার পরপরই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা পলিটেকনিক, ভিক্টোরিয়া কলেজ, বিবি রোড কলেজসহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীরা জরুরি বৈঠক করেন এবং পরদিন বৃহত্তর কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের অধিকার সাংবিধানিক। সহিংসভাবে সেই অধিকার রুদ্ধ করার প্রচেষ্টা গণতন্ত্রের পরিপন্থি। এসব ঘটনায় আমাদের শিক্ষার পরিবেশ যেমন বিঘ্নিত হয়, তেমনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের পথও বাধাগ্রস্ত করে।’
২৯ জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহ কুমিল্লায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা, নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা এবং প্রশাসনের নিরবতা কেবল শিক্ষাঙ্গনেই নয়, গোটা জেলা জুড়েই তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়। এদিনের ঘটনার পর ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের সুর আরও প্রবল হয়ে ওঠে।