৫ আগস্ট/৩৬ জুলাই : প্রবল গণপ্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ

বাসস
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৫০
৫ আগস্ট ২০২৪, সংসদ ভবন দখল করে ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাস। ছবি: তথ্য মন্ত্রণালয়

ঢাকা, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট (সোমবার) ছাত্র-জনতার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও তীব্র প্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এর মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশ স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি পায়।

শেখ হাসিনার অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শত শত মানুষ নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হন।

৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণের জন্য একদিকে যেমন বিজয়ের দিন, তেমনি এটি একটি মর্মান্তিক দিন হিসেবেও পরিগণিত। কারণ এদিন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও পুলিশের বর্বর হামলায় অনেক মানুষ প্রাণ হারান।

গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ শাসনামলে অহংকার করে বলে এসেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না’।

২০২৪ সালের ২২ জুলাই তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকেও এ কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই বক্তব্য দেওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে জনগণের প্রচণ্ড ঘৃণা ও চাপের মুখে তাকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে হয়।

৫ আগস্ট কড়াকড়ি কারফিউ উপেক্ষা করে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি সফল করতে হাজার হাজার মানুষ রাজধানী ঢাকার অভিমুখে পদযাত্রা করেন। দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর নিশ্চিত করার পর জনতার উল্লাসে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। সেই মুহূর্তে শেখ হাসিনার ক্ষমতার আধিপত্য এবং আওয়ামী লীগের কথিত রাজনৈতিক দুর্গ এক মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে।

রাজধানীর রাজপথ দখলে নেয় লাখ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে প্রবেশ করে বিজয় উদযাপন করে। শুধু গণভবন নয়, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর অসংখ্য মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদেও প্রবেশ করে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশু, বৃদ্ধ, শ্রমজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী— সবাই রাজপথে নেমে দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পতন উদযাপন করে।

শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। ৫ আগস্ট রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। দুপুরের দিকে হাজার হাজার মানুষ শাহবাগে জড়ো হতে থাকেন। শেখ হাসিনা হঠাৎ দেশত্যাগ করার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজধানীসহ সারাদেশে ছাত-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে অনেক মানুষ নিহত ও আহত হন।

২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনা ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’ ধরে রাখতে চেয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণসহ শাসনব্যবস্থায় নানা অনিয়ম ও দমনপীড়নের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি সমালোচনাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি তার উদাসীনতা এবং দমনমূলক আচরণই শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনকে এক গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেয়।

দেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি, ১ জুলাই শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এ রূপ নেবে।

শিক্ষার্থীরা শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করেই রাজপথে নামেন। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলনের মুখে সরকার এক প্রজ্ঞাপনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্ট সেই প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে কোটা পুনর্বহালের রায় দেন।

হাইকোর্টের রায়ে ফের ৫৬ শতাংশ কোটা প্রথা পুনর্বহাল হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবারও তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়।

মেধাবী শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার প্রতীক হিসেবে এই কোটা পুনর্বহালকে শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করে এবং তীব্র আন্দোলনে গড়ে তোলে।

সরকার শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সমর্থক ক্যাডারদের মাঠে নামিয়ে দেয়, যার ফলে এ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই আন্দোলনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন এবং প্রায় ২০ হাজার মানুষ আহত হন। যার ফলে দেশ রক্তাক্ত এক প্রান্তরে পরিণত হয়।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা শাহবাগে আসতে শুরু করেন। তারা যখন কারফিউ ও পুলিশের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে রাজধানীতে প্রবেশের চেষ্টা করে, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা মূলত ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ৩ ও ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের’ নামে চালানো হামলায় যথাক্রমে অন্তত ৯৩ ও ৬৬ জন নিহত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা কর্মসূচির সময় এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করেন।

আন্দোলন যখন সহিংস হয়ে ওঠে সমন্বয়করা সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায় স্বীকার করে শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য ক্ষমা চাওয়াসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা না করে আন্দোলন দমনে কৌশল অবলম্বন করে। তারা আন্দোলনের ছয়জন  সমন্বয়ক— নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, নুসরাত তাবাসসুম এবং আবু বাকের মজুমদারকে তুলে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রাখে। বাইরে থাকা কয়েকজন সমন্বয়ক তখন ৯ দফা ঘোষণা করে আন্দোলন চালিয়ে যান।

পরে ছয় সমন্বয়ক মুক্তি পাওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক জনসভায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি তুলে এক দফা ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণার পর আন্দোলনকারীদের ওপর দমনপীড়ন আরও বেড়ে যায়। এরপর আন্দোলনকারীরা ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ দিনটিকে তারা ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাদের মতে, শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস শেষ হবে না।

অবশেষে আসে সেই ঐতিহাসিক দিন ৫ আগস্ট। ভোর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও শহরতলি থেকে লাখ লাখ মানুষ রাজধানীর শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ঢাকার বাইরে থেকেও হাজার হাজার মানুষ পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে রাজধানীতে আসার চেষ্টা করেন।

পরিস্থিতি তখন ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্থির। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হাজার হাজার মানুষ জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কোনো কিছুই তাদের থামাতে পারেনি। তারা যেকোনো নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পদদলিত করে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেন— এটাই তার বাংলাদেশের মাটিতে শেষ মুহূর্ত। তাকে বিদায় নিতে হবে।

এরপর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
‘জুলাই-গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির নির্দেশনা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ‘সুজন’ প্রণীত ‘জাতীয় সনদ’ হস্তান্তর
আসুন এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না : প্রধান উপদেষ্টা
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় হত্যা মামলায় ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড
স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশে টিকতে পারবে না: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা সহায়তাকারীর: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা
৪ আগস্ট খুলনায় আন্দোলনকারীদের বিজয় উল্লাস
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আলেম-উলামাগণের সহায়তা চায় সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা
ঢাবি’র ৮ শিক্ষার্থীর ‘আয়েশা-আমিরুল ট্রাস্ট ফান্ড বৃত্তি’ লাভ
বেরোবির পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক রশীদুল সাময়িক বরখাস্ত
১০