কামরুল হাসান
কুমিল্লা, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): ক্যালেন্ডারে ৩০ দিনে এক মাস হলেও ২০২৪ সালের জুলাই মাস যেন সময়ের সেই নিয়ম মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সময় চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে। ৩১ জুলাই পেরিয়ে ১ আগস্ট, ২ আগস্ট, ৩ আগস্ট...। কিন্তু আন্দোলনের উত্তাপ ও শহীদদের অকাল মৃত্যুর ক্ষত তখন এতটাই গভীর ছিল যে দিনপঞ্জিকার তারিখ যেন মানুষের অনুভূতির সাথে তাল মেলাতে পারছিলো না। পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, আর গগনবিদারী স্লোগানে ঢেকে গিয়েছিলো শহরের দেয়াল। যেখানে উচ্চারিত হচ্ছিলো ‘সারা বাংলা খবর দে, কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘দফা এক, দাবি এক, স্বৈরাচারের পদত্যাগ’।
অবিস্মরণীয় জুলাইয়ে সময়ের হিসেব ভুলে গিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। তাদের কাছে আন্দোলনের প্রতিটি দিন ছিল একেকটা জুলাই স্মারক। অবিস্মরণীয় জুলাইয়ের সময়ের হিসেবে মেলাতেই তাদের কাছে ৫ আগস্ট হয়ে উঠেছিল ৩৬ জুলাই।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)’র ছাত্র বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লার অন্যতম সমন্বয়ক আবু রায়হান জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, জুলাই শুধু একটা মাস নয়। এটা বিপ্লবের প্রতীক। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ‘জুলাই বিপ্লব যতোদিন চলবে, জুলাই মাস ততোদিন স্থায়ী হবে’। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে ৩৬ জুলাই আমাদের চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে, আমরা স্বৈরাচারের মসনদের পতন ঘটিয়েছি।
আবু রায়হান বলেন, জুলাইয়ের প্রতিটি দিন ছিল নতুন শঙ্কা, নতুন আতঙ্ক। প্রতিদিনই নতুন কর্মসূচি, শহীদ, আহত, গ্রেফতার, গুম চলছিলো। সকল আশঙ্কা ও ভয়কে উপেক্ষা করে জুলাই যোদ্ধারা লড়ে গেছে বুক চিতিয়ে। ৩১ জুলাই যখন শেষ হল, তখনই ১ আগস্টকে প্রতীকী বা রূপকভাবে ৩২ জুলাই নামকরণ করা হয়েছিল। মুহূর্তেই তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পরে। সেভাবেই বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট হয়ে উঠে ৩৬ জুলাই।
বিশিষ্টজনদের মতে, এটা ছিল এক নতুন রাজনৈতিক চেতনার জন্মকাল। যারা রাস্তায় নেমেছিলেন, তারা শুধু কোটা সংস্কারের দাবিতে নয়,তারা নেমেছিলেন একটি অসুস্থ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
কুবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক আরাফ ভূইয়া বলেন, ‘৩৬ জুলাই- এর সূচনা হয়েছিলো জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করার কারণে। যেখানে চাকরির মতো মৌলিক বিষয়ে দুর্নীতি এবং দল দাসদের নিয়োগ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে লীগ পন্থি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এটার কারণেই সকল শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল দীর্ঘদিনের।
তিনি বলেন, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন, গুম ও খুনের কারণে এদেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ ছিল। তাদের ক্ষোভ সুনামির রূপে আবির্ভূত হয় যখন নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিলো। যার কারণে ৩৬ জুলাই বাংলার বুকে নেমে আসে। এ সময়ের মধ্যেই আমরা হারিয়েছি আবু সাইদ, মুগ্ধসহ আরও অনেকজনকে। যাদের জীবনপ্রবাহ থেমে গেছে। কিন্তু তারা আমাদের অন্তরে অমর হয়ে আছেন। সেসময় শহীদদের জন্য শোকের পাশাপাশি ছিল রাগ, বেদনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করে কুবির শিক্ষার্থী ও জুলাই যোদ্ধা পাভেল রানা বলেন, ‘সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়! আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমি যেকোনো সময় শহীদ হয়ে যাবো এবং এর জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। সেই সময়ের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত আমাদের আতঙ্কে কেটেছে। আমরা যখন শুনতাম কুমিল্লা মহানগর থেকে ২৫০টির বেশি বাইক, গাড়ি ও আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ আসছে আমাদের হলে হামলা করতে তখন স্বাভাবিকভাবেই ভয় গ্রাস করেছিল। কিন্তু আমরা সাহস হারাইনি। হল ত্যাগ করিনি। সেই আতঙ্কেও আমাদের স্লোগানে সমগ্র হল কেঁপেছিল! ‘হল আমরা ছাড়ছি না, হল কারো বাপের না!
তিনি আরো বলেন, ‘২০২৪ সালের সেই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক সচেতনতা, ঐক্যের চেতনা ও দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেম গড়ে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও বুঝতে শুরু করে রাষ্ট্রের নীতি তাদের জীবনকে কেমনভাবে প্রভাবিত করে। এই অভ্যুত্থান তাদের শিখিয়েছে সংগ্রাম মানে শুধু স্লোগান নয়, এটা আত্মত্যাগ ও আদর্শে অবিচল থাকার নাম। অনেকে নিজেদের জীবনের লক্ষ্যই পুনর্বিন্যাস করেছেন সেই অভিজ্ঞতা থেকে। বিশেষ করে জেনারেশন জি (জেন জি) জীবনের মায়া ত্যাগ করে আন্দোলন করেছে দেশপ্রেমের কারণেই।’
স্বপ্ন আর বিজয়ের আশায় আতঙ্কে দিনগুলো কেটেছে। কিন্তু তারিখ বদলায়নি হৃদয়ে। তাই সময়ের হিসেব একপাশে সরিয়ে রেখে মানুষ বলেছে ‘এখনো জুলাই চলছে’। এই ‘৩৬ জুলাই’-এর অনুভব জাতিকে শিখিয়ে দিয়েছে, প্রতিবাদ একদিনের নয়, শোক একমাসের নয়, আর ইতিহাস কোনো তারিখের গণ্ডিতে আটকে থাকে না।