ওমর ফারুক
রাজশাহী, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আজকের দিনে রাজশাহী মহানগরীতে আন্দোলনকারীদের উপর মুহুর্মুহু গুলি চালায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা।
তাদের সশস্ত্র হামলায় সেদিন নিহত হয়েছিলেন সাকিব আঞ্জুম ও আলী রায়হান। শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
আন্দোলনকারীদের উপর শেখ হাসিনা সরকারের ক্যাডারবাহিনীর হামলা ও মুহুর্মুহু গুলিতে ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নগরীতে এমন অবস্থা এর আগে কখনোই দেখেনি মানুষ। এতে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরও রাজশাহীতে ত্রিমুখী এ হামলার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরাও সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছোঁড়েন বলে জানান আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার পরে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা আরো বেশি হামলার সুযোগ পায়। আহতদের মধ্যে প্রায় ৪০ জনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরমধ্যে আলী রায়হানসহ অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ ছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আলী রায়হান নামের ওই ছাত্রশিবির নেতার মৃত্যু হয়। ৫ আগস্ট ঘোষণা দিয়েই মাঠে ছিল ছাত্রশিবির ও জামায়াত। ওই দিন রাজশাহী মহানগর ও জেলা মিলিয়ে মোট ১২১ জন আহত হয়েছিলেন। মাঠে ছিল ছাত্রদলও।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয়ভাবে সেদিন মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। কর্মসূচির সমর্থনে রাজশাহীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা আগের দিনের অসহযোগ আন্দোলন ও সরকার পতনের ১ দফায় রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষকে রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আন্দোলনকারীরা সেদিন সকাল থেকেই নগরীর তালাইমারি মোড়ে জড়ো হতে থাকেন। সকাল সাড়ে ১০টায় গণজমায়েত শুরু হয়। টানা দুই ঘণ্টা হাজার হাজার মানুষ স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন তালাইমারিসহ আশপাশের এলাকা। দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তারা সেখানেই গণজমায়েত করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছিলেন। সে সময় তারা খবর পান, হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এ খবরে অনেকেই সেখানে নফল নামাজ আদায় করেন।
আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, চব্বিশের ৫ আগস্ট সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগরীর সাহেব বাজারের দিকে রওনা হন। এদিকে আলুপট্টি মোড়ে আগে থেকেই সশস্ত্র অবস্থানে ছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে অবস্থান করছিলেন যুবলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসী দুই হাতে গুলি চালানো রুবেল। আন্দোলনকারীদের মিছিলটি স্বচ্ছ টাওয়ার মোড়ে পৌঁছালে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এরপরও আন্দোলনাকারীরা সামনে এগিয়ে যায়।
এতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা পিছু হটতে থাকে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ সদস্যরা সেখানে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে তারা আন্দোলনকারীদের ওপর পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। আবারো বেশ কিছু ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আন্দোলনকারীদের উপর মুহুর্মুহু গুলি ছোড়া হয়। বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ইট-পাটকেল ছুড়ছিলেন।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস ও টিয়ারশেল ছুড়ে। আন্দোলনকারীরা আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেখানে যুবলীগের সন্ত্রাসী রুবেল দুই হাতে আন্দোলনাকারীদের উপর গুলি চালাচ্ছিলেন। তাদের সশস্ত্র হামলায় অন্তত শতাধিক আহত হন। এরমধ্যে একটি গুলি শিবির নেতা আলী রায়হানের মাথায় লাগে। রায়হানসহ গুলিবিদ্ধ ৩০ জনকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আলী রায়হানের মৃত্যু হয়।
এ সময় নগরীর শাহ মখদুম কলেজ সংলগ্ন এলাকায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া আন্দোলনকারী সাকিব আঞ্জুমকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা হয়। তাদের ত্রিমুখী হামলার মধ্যেও আন্দোলনকারীরা প্রতিরোধের ব্যাপক চেষ্টা করে। এভাবে টানা দুপুর প্রায় সোয়া ১টা পর্যন্ত হামলা চলে।
এরপর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর খবরে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এবং পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। সে সময় রাস্তায় হাজার মানুষ নেমে আসে বিজয় উদ্যাপন করে।
এদিকে, রাজশাহীর গাদাগাড়ী উপজেলা সদরে আন্দোলনকারীরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলি ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। সেখানেও বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হলে তাদের রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাজশাহী মহানগর আশেপাশের উপজেলা মিলিয়ে ৫ আগস্ট আহত হয়েছেন ১২১ জন ও শহীদ হয়েছেন ২ জন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক মিশকাত চৌধুরী মিশু বাসসকে বলেন, আমরা মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির সমর্থনে রাজপথে ছিলাম। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সাহেব বাজারের দিকে রওনা হলে পথে স্বচ্ছ টাওয়ার ও আলুপট্টি মোড়ে আগে থেকেই সশস্ত্র অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা করে। আমরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তখন পুলিশ আমাদের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
তখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা একতরফাভাবে হামলা চালিয়ে আমাদের প্রায় শতাধিক ভাইকে আহত করে এবং সাকিব আঞ্জুমকে হত্যা করে। অবশেষে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এ বিজয় পুরো দেশবাসীর। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় আগামীর বাংলাদেশকে বৈষম্যমুক্ত করে গড়ে তুলতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবরে রাজশাহী মহানগরের রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ নেমে আসে। বিজয় উদ্যাপন করেন নেচে গেয়ে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত ম্যুরাল ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ রাস্তায় রাস্তায় বিজয় উদ্যাপন করেন।