মুহাম্মদ নূরুজ্জামান
খুলনা, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার খবরে চব্বিশের ৫ আগস্ট উল্লাসে মেতে ওঠে খুলনার সাধারণ মানুষ। বিকেল তিনটার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ সড়কে নেমে আসে। রাজপথে নেমে ছাত্র-জনতা ও শ্রমজীবী মানুষ বিজয় মিছিল করে। এরই মধ্যে খুলনায় সেনা বাহিনীর সাঁজোয়া যানকে স্বাগত জানায় ছাত্র-জনতা। বিশেষ করে সেনা সদস্যদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
এদিন সকালে সারাদেশে চলমান অনির্দিষ্টকালের কারফিউ এর মধ্যেই খুলনায় ৫ আগস্ট সকাল থেকেই নগরীর শিববাড়ি মোড়ে জমায়েত হতে শুরু করে ছাত্র-জনতা। বেলা গড়াতেই সেখানে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। এ সময় স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয় শিববাড়ি মোড়।
এসময় সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের একটি বহর শিববাড়ি মোড়ে পৌঁছলে শিক্ষার্থীরা করতালির মাধ্যমে তাদের স্বাগত জানান। এ সময় ‘এই মুহূর্তে দরকার সেনাবাহিনীর সরকার’ বলেও স্লোগান দেয়া হয় ছাত্র-জনতা।
এ সময় সেনা সদস্যরা মাইকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা শান্ত থাকেন। ছাত্রদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো বিরোধ নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৪ আগস্ট ছাত্র জনতা খুলনায় প্রথম বিজয়ের সূচনা করে। যার জের ধরে খুলনায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়, তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিনের বাড়ি 'শেখ বাড়ি' ছাড়াও বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। নগর ভবন, জেলা পরিষদ ও প্রেসক্লাবে হামলা করা হয়। পরে আরেক দফা ভাঙচুর করে প্রেসক্লাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে আন্দোলনকারীরা নগরীর পিটিআই মোড়ে ২৮ নং ওয়ার্ডের ওই সময়কার ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল আহসান টিটোর কার্যালয়, রয়্যাল মোড়ে ২৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল ইসলাম টিটোর ব্যক্তিগত কার্যালয়, গল্লামারী এলাকায় যুবলীগ নেতা শেখ হাফিজুর রহমান হাফিজের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া শের-এ বাংলা সড়কে আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন হোটেল গ্র্যান্ড প্লাসিড ও ফারাজীপাড়া এলাকায় মহানগর যুবলীগের সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশের ফ্ল্যাটে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এছাড়া শেখপাড়া এলাকায় ২০ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। নগরীর কেডিএ অ্যাভিনিউতে বাংলালিংক অফিস ভাঙচুর করে সামনে রাখা ৪টি মোটর সাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
আন্দোলনকারীরা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামান জামাল, সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মূর্শেদীর ব্যক্তিগত কার্যালয় ও খুলনা ক্লাবে ভাঙচুর করে। তারা খুলনা ক্লাব ও সাবেক সংসদ সদস্যের অফিসের নিচে থাকা ৩টি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়।
নগরীর গ্যালাক্সি মোড়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তরে হামলার চেষ্টা চালায়। আন্দোলনকারীরা গগণবাবু রোডে তৎকালীন সিটি মেয়রের বাড়িতে ভাংচুরের চেষ্টা চালায়। এ সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলে। হামলা করা হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজিত কুমার অধিকারীর বাসভবনেও।
৫ আগস্ট বিকেলে খুলনার কয়রায় বিকেলে ছাত্র-জনতা মিছিল বের করলে আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান মহসিন রেজার বাড়ি থেকে গুলি করা হয়। গুলিতে সাব্বির, আলতাফ, আবু মুছা, নূরুজ্জামানসহ ১০ জন আহত হন। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার বেলা তিনটার দিকে খণ্ড খণ্ড মিছিলে কয়েকশ' জনতা কয়রা সদরে আনন্দ মিছিল বের করে। একপর্যায়ে সাবেক এমপি আক্তারুজ্জামান বাবুর বাড়িতে আগুন দেয়। বিকেল ৪টার দিকে উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম মোহসিন রেজার বাসভবন ঘেরাও করলে তার বাসভবন থেকে গুলি নিক্ষেপ করা হয়। এতে দশ জন জনতা গুলিবিদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ফের মোহসিন রেজার বাসভবনে মিছিলকারীরা আক্রমণ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আগুনে পুড়ে চেয়ারম্যান মোহসিন রেজার মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা মহানগরের উপদেষ্টা মিনহাজুল আবেদিন সম্পদ বাসসকে বলেন, ‘৫ আগস্ট সকাল থেকেই মানুষের মাঝে আশঙ্কা, সংশয় ও ভয় ছিল। তবে এসবকে পেছনে ফেলে অনেকেই আন্দোলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা জানতেন, এই দিনটির গুরুত্ব কতটা এবং তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। দুপুর ৩ টার দিকে ঘোষণা আসে ‘বাংলাদেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে’। এই ঘোষণা যেন একটি নতুন সূর্যোদয় ছিল। এ ঘোষণা আন্দোলনকারীদের মধ্যে উদ্দীপনা নিয়ে আসে। উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। খুশির আকাশে তারা নিজেদের স্বপ্নের প্রতিফলন দেখতে পায়। আন্দোলনকারীরা একত্রিত হয়ে জয়গান গাইতে শুরু করে। এদিন সবাই তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন এবং বলেন কীভাবে তারা একসাথে সংগ্রাম করেছেন। জনসাধারণের সবার মধ্যে ছিল বিজয়ের অনুভূতি।
মিনহাজ জানান, যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য বিজয়ের দিনটি ছিল একটি ঐতিহাসিক বিজয়। তিনি বলেন, ‘আমরা একত্রিত হয়ে এই অন্ধকার সময় কাটিয়ে উঠেছি। আজ, আমরা সেই দেশের নাগরিক, যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং মানুষ নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে।’
এই বিজয় দিনটি ছিল শুধু একটি রাজনৈতিক সাফল্য নয়। বরং এটি ছিল দেশের মানুষ ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি প্রমাণ। মিনহাজুল আবেদীন সম্পদ বলেন, তারা নিজেদের অধিকার রক্ষায় কখনো পিছপা হবেন না। বিজয়ের দিনে মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তাদের অবদানের জন্য প্রস্তুত হয়।