ইসমাঈল আহসান
ঢাকা, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ফ্যাসিবাদের পতনের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশের মানুষ দেখেছিল দ্বিতীয় স্বাধীনতা। কিন্তু এ বিজয়ের জন্য বিশেষত জুলাই দ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া উত্তরাবাসীকে দিতে হয়েছে বিরাট মূল্য।
দেশের মানুষ যখন বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত, ঠিক সেই মুহূর্তে উত্তরার বিজয় মিছিলে পুলিশ, র্যাব, এপিবিএনসহ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতা। আজ এক বছর পরও, এই সংখ্যাটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি জাতি।
‘উত্তরা ব্যারিকেড ভাঙাই ছিল হাসিনা পলায়নের মূল কারণ’-এ শিরোনামটি গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোর। আসলেই, উত্তরার মানুষ যেভাবে পঙ্গপালের মতো ব্যারিকেড ভেঙে গণভবনের দিকে ছুটে গিয়েছিল, সেটিই বদলে দিয়েছিল ৫ আগস্টের দৃশ্যপট। পথে পথে দেখা গিয়েছিল এক অনন্য দৃশ্য-শত শত মানুষ পানির বোতল, চকলেট, বিস্কুট, কোমল পানীয়সহ হালকা খাবার বিতরণ করছেন আন্দোলনকারীদের মাঝে।
উত্তরা ছিল মূলত শান্ত একটি আবাসিক এলাকা। অতীতে কোনো আন্দোলনেই বিএনপি বা জামায়াত উত্তরায় শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। কিন্তু ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ ৬ জন শহীদের ঘটনার দিন উত্তরা বদলে যায়। পুরো ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরুদ্ধ করে রাখে উত্তরাবাসী। এরপর ১৮ ও ১৯ জুলাই পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের হামলায় বহু মানুষ শহীদ হন। ছাত্রদের অদম্য প্রতিরোধে ক্ষমতাসীনদের ভিত কেঁপে ওঠে, আর উত্তরা হয়ে ওঠে সরকারের মূল টার্গেট।
১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত উত্তরায় চলতে থাকে এক রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধযুদ্ধ। কিন্তু ৫ আগস্ট সকাল থেকেই গাজীপুরসহ আশপাশের মানুষ ভিড় জমায় বিএনএস টাওয়ারের সামনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক ব্যারিকেড বসালেও সকাল ১১টার দিকে আন্দোলনকারীরা তা ভেঙে ফেলে। সেনাবাহিনী বাধা দিলেও জনতার স্রোতের কাছে নতি স্বীকার করে। বিমানবন্দর সড়কে তখন একটাই গন্তব্য-গণভবন, একটাই দাবি-যে কোনো মূল্যে হাসিনার পতন।
অন্যদিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে আরেকটি বিশাল জনসমাবেশ। তারা শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙা ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের দাবি জানায়, যাতে ফ্যাসিস্টরা পালিয়ে যেতে না পারে। দুপুর তিনটার দিকে সেনাবাহিনী ব্যারিকেড সরিয়ে দিলে জনতা বিমানবন্দরে ঢুকে পড়ে।
যখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিজয়ের উচ্ছ্বাস, ঠিক তখনই উত্তরায় শুরু হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। উত্তরা পূর্ব থানা, র্যাব-১ সদর দফতর ও এপিবিএন কার্যালয় থেকে নির্বিচারে গুলি চালানো হয় জনতার উপর। অসংখ্য মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। বিল্ডিংয়ের ছাদ ও ভেতর থেকে গুলি আসায় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। গুলি চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বিক্ষুব্ধ জনতা পরে উত্তরা পূর্ব থানা জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে শহীদ হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ, আহত হয়েছে তিন শতাধিক।
এই শহীদরা জীবন দিয়ে আমাদের উপহার দিয়েছেন একটি নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। আর আহতরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে বিকলাঙ্গ জীবনের মধ্য দিয়ে সেই স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধ করে চলেছেন। আজও শহীদদের সঠিক সংখ্যা আমরা বের করতে পারিনি-এ ব্যর্থতা আমাদেরই। তবে তাদের ত্যাগ ও অবদান যেন ইতিহাসে চিরভাস্বর থাকে, সেটিই হোক আগামী প্রজন্মের অঙ্গীকার।