চুপ কর, কথা বললেই গুলি করে দেব বলে হুমকি পুলিশের : নাহিদুল ইসলাম

বাসস
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১৯:০৬
মো. নাহিদুল ইসলাম। ছবি : ফেসবুক

পলিয়ার ওয়াহিদ

ঢাকা, ৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা মো. নাহিদুল ইসলাম। ৩১ জুলাই গ্রেপ্তারের সময় কথা বলতে গেলে পুলিশ তার তার মুখ চেপে ধরে। সেই ছবি ও ভিডিও মুহূর্তে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। নাহিদ বলেন, মার্চ ফল জার্টিস পালন করার জন্য মিছিল নিয়ে মৎস্য ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। মিছিল থেকেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ন্যায্য। আপনারা এভাবে আমাদেন বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করতে পারেন না। কিন্তু পুলিশ উল্টো তার মুখ চেপে ধরে। এমনকি তাকে ‘চুপ কর, কথা বললেই গুলি করে দেব’ বলেও হুমকি দেয়।

নাহিদুল ইসলামের জন্ম ২০০১ সালের ২ এপ্রিল লক্ষীপুর জেলার রামগতি সদরে। পিতা গাছ ব্যবসায়ী মো. সিরাজ উদ্দিন ও মা মৃত বিবি কুলসুমের ছোট ছেলে তিনি। লেখাপড়া করছেন ঢাকার ধানমন্ডির নিউ মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষে।

তিনি মনে করেন, বৈষম্যহীন একটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আমূল সংস্কার ছাড়া এই দেশের মানুষের কোনো মুক্তি নেই। সেই লক্ষে সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন। ২০১৪ সাল থেকে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক পথচলা শুরু। ছাত্র প্রতিনিধি হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন স্কুল শাখায়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। 

২০১৮ সালে উপজেলার প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া ২০১৮ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনসহ বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নাহিদুল।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র (বাসস) বিশেষ আয়োজন ‘জুলাই জাগরণ’ এর মুখোমুখি হয়ে জুলাইয়ে রাজপথের অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন নাহিদুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন পলিয়ার ওয়াহিদ।

বাসস : প্রথমে শুনতে চাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনি কেন অংশগ্রহণ করলেন? কোন আকাঙ্খা থেকে?

নাহিদুল ইসলাম : স্বাধীনতার পর থেকে একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়া যোদ্ধাদের বঞ্চিত করা হয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসনব্যবস্থা বহাল রেখে। সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল তাদেরকে। একটি দল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল। সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়া যোদ্ধাদের উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়া হয়নি। এই যে বৈষম্যের সূত্রপাত হয় তার ধারাবাহিকতায় কোটার নামে একটি বিশেষ দলের পক্ষে গোষ্ঠী তৈরি করা হচ্ছিল। এই গোষ্ঠীই ওই দলটিকে নানা অপকর্মে সহযোগিতা করে আসছিল। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে ওই গোষ্ঠী তথা ওই দলের অপকর্মের চিত্র সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরাই ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। আমরা আশা করছিলাম, এই কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কারের পাশাপাশি বৈষম্যমূলক দেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো, রাষ্ট্র পরিচালনা এমন কি দেশের বেকার সমস্যা থেকে শুরু করে সব কিছুরই আমূল পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই স্বপ্ন নিয়ে সেদিন আমরা কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছি। এ ছাড়া আমার ভাইদের অবিচারে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করা হচ্ছিল। 

কোনো সুস্থ মানুষ এসব দৃশ্য দেখে ঘরে বসে থাকতে পারে? পারে না। ফলে মানুষ হিসেবে মানুষের মানবিক জায়গা থেকে আমি রাজপথে নেমেছিলাম। এ ছাড়া গত ১৭ বছর সবগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমি সামনের সারিতে উপস্থিত ছিলাম।

বাসস : আগামীতে যদি আবার ডাক আসে যাবেন?

নাহিদুল ইসলাম : কেন যাব না। অবশ্যই যাব। যতদিন প্রাণ আছে ততদিন সত্য এবং ন্যায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবো। কারণ আমরা বুঝতে পারছি জুলাই শেষ হয়নি। জুলাই মাত্র শুরু। এই রক্ত কোনোভাবে বৃথা যেতে পারে না। আমরা রাজপথেই আছি। এখনো ঘরে ফিরতে পারিনি। এই দেশের আমূল সংস্কার ছাড়া আমরা ঘরে ফিরবো না। এক দলে পালিয়ে গেছে আরেক দল দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু পরিবর্তন হলো কোথায়? আমরা পরিবর্তন চাই। যত দিন সেই কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবে না। ততদিন সংগ্রাম করব।

এ ছাড়া আগের প্রশ্নে কিছু বাকি কথা বলি- ট্যাগিংয়ের রাজনীতি বন্ধ করা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভালো হওয়া সম্ভব নয়। এই ট্যাগিংয়ের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্যেই কিন্তু এই জুলাই গণঅভ্যুত্থান। কারণ কখনো জামায়াত-শিবির বলে যাকে তাকে যখন তখন হত্যা করা হয়েছে। কখনো মাদ্রাসার শিক্ষক, কখনো পাহাড়ি নেতাকে জঙ্গি ট্যাগিং দিয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্র যে পরিমাণ নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছে সেটা সবাই জানেন। গুম খুন ছিল একেবারে পান্তাভাত। আর এসব জায়েজ করা হতো ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে। সেই ট্যাগিং আসলে দাগি আসামির মতো ক্ষত তৈরি করেছিল ব্যক্তি ও সমাজের মনে। আর সেই ক্ষত শুকানোর জন্য বা সেই ক্ষত থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ রাজপথে নেমেছিল।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ১ বছর পূর্ণ হলো। জুলাইয়ের সেই স্মৃতি কতটা অনুভব করেন?

নাহিদুল ইসলাম : সত্যি বলতে আমি জুলাই-আগস্টে ঘটা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিভীষিকাময় স্মৃতি স্মরণ করতে চাই না। সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও আমাকে ভেতর থেকে কষ্ট দেয়, পীড়া অনুভব করি। 

গণআন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি আমাকে ব্যথিত করে। আমি এখনো যন্ত্রণা অনুভব করি আহতদের আর্তনাদে। তাদের স্বপ্নের বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণ ছাড়া সেই সময়ের স্মৃতি বেদনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছে না।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আপনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। আপনার মুখ চেপে ধরা সেই ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। সে প্রেক্ষাপট বিস্তারিত শুনতে চাই।

নাহিদুল ইসলাম : পূর্ব ঘোষিত ‘মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি ছিল ৩১ জুলাই। সেই দিন আমি মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট এলাকায় আসলে পুলিশ আমাকে ঘিরে ধরে। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা আমার মুখ চেপে ধরে। আমাকে কোনো কথাই বলতে দেওয়া হচ্ছিল না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি ভাবছিলাম এই দেশ স্বাধীন করার জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষেরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন? এই পুলিশ বাহিনীতে কি স্বাধীন দেশের নাগরিক কর্মরত? একজন নাগরিক হিসেবে আমার কথা বলার অধিকার থাকবে না? অন্যায়ের স্বীকার হলে তার প্রতিবাদ করতে পারব না? রাষ্ট্র এভাবে একজন নাগরিকের মুখ চেপে ধরতে পারে? সেই ছবি যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তখন আমার সহযোদ্ধা, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়েন সেই পুলিশ কর্মকর্তা। আমাকে প্রায় ৩ ঘণ্টা আটকে রাখে।

তবে আমার খুব খারাপ লেগেছিল যখন পুলিশ বলে, কথা বলবি না। কথা বললে তোকে গুলি করব। আমি সত্যি সেই স্মৃতি কল্পনা করতে চাই না। কারণ পুলিশ আমাকে গাড়িতে তুলে খুব নির্যাতন করে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমরা যারা রাজপথে ছিলাম আমরা ট্রামট্রাইজ হয়ে আছি। আমরা শান্তি পাচ্ছি না। 

শহীদ আর আহতদের কথা মনে পড়ে। তাহলে কীভাবে ঘুমাবো, বলেন? আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ। অথচ আমাদের দিকে তাকানোর কেউ নেই। আমাদের খবরও কেউ নেয় না। আমরা কীভাবে আছি কেউ কখনো খবর নেয়নি। রাষ্ট্রের যে মেরামত করতে নেমেছিলাম সেই মেরামত কদ্দুর?

বাসস : আন্দোলনে আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কেমন ছিল?

নাহিদুল ইসলাম : আন্দোলনে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে আপোষকামী মনোভাব ছিল। ফ্যাসিবাদী শাসনের দোসর অধ্যক্ষ এবিএম বেলাল হোসেন ভুইয়া এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। এটা ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও শহীদের রক্তের অপমান।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনো কাউকে বলেননি এমন কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি জানতে চাই।

নাহিদুল ইসলাম : এ রকম অনেক বিষয়ই আছে। মৃত্যুর আশঙ্কা আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াতো। আমরা জানতাম এ ধরণের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধের সংগ্রাম কতটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমরা যখন লক্ষ্য করলাম, গণআন্দোলনকে মোকাবিলায় ফ্যাসিবাদী সরকার গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে। আমরাও তখন কৌশল পরিবর্তন করি। 

বাসস : সরাসরি জুলাইয়ের কত তারিখে এবং কোথায় আন্দোলনে যুক্ত হন?

নাহিদুল ইসলাম : আমি দীর্ঘ সময় ধরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয়কর্মী ছিলাম। হঠাৎ করেই জুলাই মাসের আন্দোলনে এসে যোগ দেইনি। ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিটি যৌক্তিক গণআকাঙ্ক্ষার আন্দোলনে অংশ নিয়েছি, নেতৃত্ব দিয়েছি। কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলনের শুরু থেকেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি, নেতৃত্ব দিয়েছি। এখানে তারিখ উল্লেখ করার মতো কিছু দেখছি না। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থান মাঠ পর্যায়ের সংগঠকদের সৃষ্ট গণআন্দোলন। 

বাসস : আন্দোলনকারী হিসেবে এক দফা ঘোষণার আগে কি বুঝতে পেরেছিলেন হাসিনা পালিয়ে যাবে?

নাহিদুল ইসলাম : সেই সময়টা খুব জটিল ছিল। প্রতিদিনই আন্দোলনের পারদ উঠানামা করছিল। যখন কারফিউ ঘোষণা করা হয় তখন মোটামুটি পরিস্কার হয়ে যায় সরকার রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। 

গণগ্রেফতার, গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। ওই সময়ে একটা অদ্ভুত বিষয় অনুভব করেছি। 

ফ্যাসিবাদী সরকার টিকে থাকার জন্য যত কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছিল সারাদেশের মানুষের মধ্যে তত বেশি ঐক্য ও তৎপরতা দেখা যাচ্ছিল। এই বিষয়টি আন্দোলনকে ধরে রাখা ও যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে আমাদেরকে মানসিকভাবে শক্তি যুগিয়েছিল। ৩ তারিখ যখন ফের কারফিউ ঘোষণা করা হয় তখন মোটামুটি পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন অনিবার্য হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল সারাদেশের শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝে যে প্রতিবাদের ঝড় আর ঐক্য তা থেকেই ফ্যাসিস্টের পতনের বার্তা আসছিল। 

এটা না বোঝার মতো কিছু ছিল না।

বাসস : ৫ আগস্ট তথা ৩৬ জুলাই সকালে কোথায় আন্দোলন করেন? হাসিনা পালানোর খবর প্রথম কখন কার মাধ্যমে পান? সেই অনুভূতি কেমন ছিল?

নাহিদুল ইসলাম : আন্দোলন চলাকালে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নানান জায়গায় নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। প্রতিদিনই স্থান পরিবর্তন করতে হতো নানা কারণে। যেদিন যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হতো সেদিন সেখানেই দায়িত্ব পালন করেছি। ৪ তারিখ রাত থেকেই আমরা রেলগেট অবরোধ করে রাখি। ৫ তারিখ সকাল থেকে আমরা ধীরে ধীরে শাহবাগ মুখি হতে শুরু করি।

সর্বপ্রথম আ স ম আবদুর রব এর সহধর্মিণী আমাদের নেত্রী মিসেস তানিয়া রবের কাছ থেকে আমাদের নেতা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বৈ,স) এর কেন্দ্রীয় সভাপতি তৌফিক উজ জামান পীরাচা ভাইয়ের কাছ থেকে নির্দেশনা আসে শাহবাগের দিকে জমায়েত করার জন্য। সেই দিন বেলা ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে আমাদেরকে জানানো হয়, ‘শেখ হাসিনা পালানোর জন্য রেডি হয়েছে। সবাই শাহবাগ হয়ে সংসদ এলাকার দিকে মুভ করো।’

বাসস : আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ বা ছাত্রলীগের হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

নাহিদুল ইসলাম : সেই বীভৎসতার দৃশ্য পুরো জাতি দেখেছে। এই দৃশ্য এখনো জাতির মানসপটে দাগ কেটে আছে। আপনাদেরও নিশ্চয়ই স্মরণ থাকার কথা কীভাবে সন্ত্রাসী কায়দায় আন্দোলনকারী, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, রিক্সাচালক এমন কী নারীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তাদের সেই অত্যাচার ও নির্যাতন পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা আশা করি, এই ধরণের নৃশংস দৃশ্য বাংলাদেশে আর কখনো ফিরে আসবে না। সেই সন্ত্রাসী হামলাগুলো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও মৃত্যু উপেক্ষা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্ভুদ্ধ করেছিল। ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলন তখন বাঁচার লড়াই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ফ্যাসিবাদী শাসনের হাত থেকে রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত করেছিল।

বাসস : জুলাই আন্দোলনের নারী শিক্ষার্থীরা ভিন্ন মাত্রা দেয়। তাদের নিয়ে বলুন?

নাহিদুল ইসলাম : এই দেশের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রাম, সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অগ্রণী ভূমিকা অনিস্বীকার্য। আমাদের বোনেরা যদি এগিয়ে না আসতেন এই আন্দোলন এতটা বেগবান হতো না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে আন্দোলনকারী একজন বোনকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা যেভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল তার প্রতিবাদে সেদিন সম্মিলিত কণ্ঠস্বর জেগে উঠেছিল। এই আন্দোলনে নিজেদের সম্মান রক্ষা ও শহীদ ভাইদের রক্তের বদলা নিতে আমাদের বোনেরাও সেদিন সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এমন কি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নারীরা, যারা সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিতে পারেননি তারা নানাভাবে আন্দোলনের রসদ যুগিয়েছেন। আমি তাদের এই অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। আমি গর্ব করি এমন সাহসী ও প্রতিবাদী বোনদের নিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা আমাদের বোনদের যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। কারো কারো বা কোনো কোনো শক্তির নীচু মন-মানসিকতার কারণে। কেউ কেউ তো ফ্যাসিস্টদের মতো জুলাইকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করছেন। যেমনটা ফ্যাসিস্টরা মনে করতো, একাত্তর তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি।

বাসস : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন থমকে গিয়েছিল তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাঠে নামে। তারা অবহেলিত হয়েছে। তাদের নিয়ে কি মন্তব্য করবেন?

নাহিদুল ইসলাম : যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি, রক্ত দিয়েছি, শহীদ হয়েছি। সেই বৈষম্যমূলক আচরণ ও মন-মানসিকতার স্বীকার হয়েছেন আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাই-বোনেরা। 

বিনা স্বার্থে যারা আমাদেরকে ভাই মনে করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, সেই বীর সেনানীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। মূলত, ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন হলেও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ও মন-মানসিকতা এখনো বহাল রয়েছে।

বাসস : আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের জন্য আপনারা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?

নাহিদুল ইসলাম : ৫ আগস্টের পর আহতদের খোঁজ-খবর নেওয়ার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল। আমি আমার সাধ্যমত আহতদের দেখতে গিয়েছি। তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত সামর্থ যেহেতু সীমাবদ্ধ তাই পদক্ষেপ নেওয়ার মতো কিছু নেই। যারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তাদেরকে এই প্রশ্নটা করা যৌক্তিক। আমারও প্রশ্ন, তারা কি করেছে? রাষ্ট্র এই শহীদ ও আহত বীর যোদ্ধাদের জন্য কি করবে? তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির যে বিষয়টা তোলা হলো তার সমাধান কি? তাদের পূর্নবাসনে সরকারের পদক্ষেপ কি? তার বাস্তবায়ন কতটুক?

বাসস : সরকার তো শহীদ পরিবারের জন্য জুলাই ফাউন্ডেশন তৈরি করেছিল। সেখানে কখনো গেছেন?

নাহিদুল ইসলাম : আমি সেখানে কখনো যাইনি। কারণ তাদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই অভিযোগ ছিল। তারা তো ব্যর্থ সেটা প্রমাণিত হয়েছে। ঠিক মতো শহীদদের তালিকাই করতে পারছে না।

বাসস : জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন ১৪ শত শহীদ হওয়ার কথা জানিয়েছে। বিদেশি মিডিয়া এত শহীদদের খোঁজ পেলেও সরকার এখনো মাত্র ৮শ শহীদের তালিকায় আটকে আছে?  আপনার মন্তব্য কী?

নাহিদ ইসলাম : ভাই আমরা মাঠে ছিলাম। শহীদ কম করে হলেও দুই হাজারের বেশি হবে। কত ভাইয়ের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। কারও কারও লাশ পাওয়া যায়নি। কাউকে হয়তো নদীতে ফেলেছে। আর লাশ পুড়ানোর দৃশ্যতো আমরা দেখেছি। রায়েরবাজারে গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। 

সেসব লাশ এখনো শনাক্ত করে পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারেনি সরকার। এসব আর বলতে চাই না। দুঃখ লাগে। সেই মুক্তিযুদ্ধের পর যা হয়েছিল সেটাই হচ্ছে। এটা কীভাবে মেনে নেব?

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কোন দিনটি আপনাকে এখনো বিশেষভাবে আলোড়িত করে?

নাহিদুল ইসলাম : ছাত্রলীগের পলায়ন এবং ফ্যাসিস্টের পতন এই দুইদিন যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা কোনো ভাষায় অনুবাদ করতে পারব না। কারণ ছাত্রলীগের পতনের দিন আমি বিশ্বাস করেছিলাম হাসিনা আর থাকতে পারবে না। সারাদেশের মানুষ তারপর দিন মাঠে নেমে এসেছিল।

বাসস : কোটা আন্দোলন কীভাবে গণআন্দোলনে রূপ নিল?

নাহিদুল ইসলাম : এটা খুবই সহজ প্রশ্ন। আবু সাঈদ যেদিন শহীদ হলেন। সাঈদ ভাই মূলত আমাদের দূত। তিনিই ইমাম। শহীদরাই আমাদের নেতা। আহতরাই আমাদের রাহাবার। ওয়াসিম, মুগ্ধ এভাবে শহীদদের সংখ্যা যতই লম্বা হয়েছে হাসিনার পতন ততই ঘণীভূত হয়েছে।

কারণ মানুষ আর সহ্য করতে পারেনি। কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো বোন। এভাবে  যখন মায়ের কোল খালি হচ্ছে। বাবা তার সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েছে। তখন মানুষ নেমে এসেছে। বোঝা গেছে মানুষ এখনো কারো অন্যায় মেনে নেবে না। যতই ভয় আর ক্ষমতা ব্যবহার করা হোক না কেন।

এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যেদিন কফিন মিছিল করি। গায়েবানা জানাজা শেষে সেই মিছিলে কীভাবে পুলিশ হামলা করেছিল মনে আছে? মানুষ তো এসব দেখেছে।

শিক্ষার্থীদের ওপর কীভাবে নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ফলে অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ ফুঁসে ওঠে। মানুষ তো। সবার শরীরে এখনো লাল রক্তই বইছে। ফলে কতক্ষণ তারা চুপ থাকবে। কতক্ষণ ভয় পাবে? রক্ত মানুষের ভয় কাটিয়ে দিয়েছিল।

বাসস : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কতটা হল?

নাহিদুল ইসলাম : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন এখনো অধরা। বলা যায়, এটি এখন একটা দুঃস্বপ্নে রূপ নিচ্ছে প্রতিদিন। এ দেশের গণমানুষের ত্যাগকে অতীতে যেভাবে অস্বীকার করা হয়েছে, আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এইভাবেই যদি ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ চলবে তাহলে এতগুলো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ আসলে কী পেল? যে রিক্সাচালক সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে নিয়ে গেছেন সেই রিক্সা চালক কি পেলেন? আমাদের স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসনব্যবস্থা। কিন্তু আমরা তো দেখছি সেই ফ্যাসিবাদী বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাই এখনো বহাল রয়েছে। স্বপ্নই হারিয়ে যাচ্ছে আর তার বাস্তবায়ন কোথায় হবে? তবে এ কথাও সত্য যে এ দেশের মানুষ স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ়চেতা। যখন এই বঞ্চিত মানুষ আবার জেগে উঠবে তখন আজকের লম্ফঝম্ফকারীদের কী হবে? কোথায় যাবেন?

বাসস : স্বৈরাচার পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কি?

নাহিদুল ইসলাম : স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পরিবর্তন। যার উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করা হয়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনো স্বৈরাচার মুক্ত হয়নি। আমাদেরকে স্বৈরাচার প্রতীক হিসেবে একজন ব্যক্তিকে দেখানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তটাই স্বৈরাচারী। এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক বন্দোবস্ত গড়ে তোলার প্রত্যাশাই আমাদের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বুড়িচং- ব্রাহ্মণপাড়া উন্নয়ন সংস্থার মতবিনিময় সভা
২০২৪ সালে জাপানের জনসংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে
পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে জুলাই মাসে চীনের রপ্তানি বেড়েছে ৭.২ শতাংশ
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা স্কিম প্রবর্তনে কর্মশালা অনুষ্ঠিত
সিকিউরিটিজ বন্ধক, অবমুক্তকরণ ও বাজেয়াপ্তকরণ নিয়ে ডিএসই’র কর্মশালা
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএনপির বিজয় মিছিলে জনতার ঢল
ফ্যাসিবাদ পতনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিএনপির বিজয় র‌্যালিতে জনদুর্ভোগ, দুঃখ প্রকাশ
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে খাদ্যশস্য মজুদ আছে ২১ লাখ মেট্রিক টন
এক বছরে বিমান খাতে রূপান্তরমূলক অগ্রগতি দৃশ্যমান
বাজার পরিস্থিতি এখন আরো স্থিতিশীল, ‘ব্যবসা সহজীকরণে’ সংস্কার চলমান
১০