ঢাকা, ১৭ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): ‘আমি আশপাশে যত হাসপাতাল আছে সব হাসপাতালে ছেলের খোঁজ করি। আমি আইসিইউতে ঢুকে রোগীদের মুখ দেখে ছেলেকে খুঁজেছি। যে সব বেওয়ারিস লাশ ছিল তা আমি উল্টেপাল্টে দেখেছি।’
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেয়া সাক্ষীর জবানবন্দিতে একথা বলেন আশুলিয়া শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহীনা বেগম।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে শাহীনা বেগম বলেন, আমি জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের আম্মু। আমার ছেলে সাজ্জাদ হোসেন সজল গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় বাইপাইল এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয়। আমি আশুলিয়ায় নারী ও শিশু হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করতাম। আমার ছেলে আন্দোলনে যায় এবং আমি হাসপাতালে ডিউটিতে যাই। হাসপাতালে অনবরত গুলিবিদ্ধ রোগী আসছিল। তখন আমি বার বার ছেলেকে ফোন করে বলি, বাবা তুমি বাসায় ফিরে আসো। হাসপাতালে অনেক গুলিবিদ্ধ আহত রোগী আসতেছে, তোমার আন্দোলনে থাকার দরকার নাই। তখন সে আমাকে বলে, তুমি এমন স্বার্থপর কেন আম্মু? আমি এখন বাসায় যেতে পারবো না। আমার সামনে চার চারটা লাশ এবং আমি একজন আহতকে ধরে বসে আছি। সকাল এগারোটা বা সাড়ে এগারোটার দিকে আমার হাসপাতালে দুটি ডেড বডি আসে। অনেক আহত রোগী আসে। তখন আমি আমার ছেলেকে আবার ফোন করি। তখন ছেলে বলে, আমাকে তুমি কীভাবে ফেরত আসতে বলো। আমি তখন বলি তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তোমার একটি মেয়ে আছে। তোমাকে আমি ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই। কিন্তু সে বাসায় ফিরে আসেনি। তখন সে আমাকে জবাব দেয়, মা আমি যদি মারা যাই, তাহলে হাজার সন্তান তোমার পাশে দাঁড়াবে। তুমি আমার চিন্তা করো না। তারপর আরো দুটি ডেড বডি আমার হাসপাতালে আসে। আমি দৌড়ে রিকশার কাছে যাই এবং ভাবতে থাকি এই বুঝি আমার ছেলে হাসপাতালে আসলো। এসময় একজন বুকে গুলিবিদ্ধ আহত ছেলে আমাদের হাসপাতালে আসে। আমি তাকে এক্সরে রুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ওই সময় ছেলেটি তার মাকে ফোন করে এবং বলে আম্মু আমি ভালো আছি। আরেকজন আহত ছেলেকে আমি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই ছেলেটিও তার পাশে থাকা বন্ধুকে বলছিল, আমার অবস্থা আম্মুকে বলো না, তাকে বলো আমি ভালো আছি। নাহলে আম্মু অনেক চিন্তা করবে। এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমি আমার ছেলেকে বার বার ফোন দিতে থাকি। তারপর আবার তাকে ফোন করে বলি, যদি আন্দোলন করতেই চাও তবে এখানে না থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও, সেখানে তোমার আরো আন্দোলনকারীরা আছে। আমার ছেলে তখন উত্তর দেয়, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো আম্মু? আমার ভাই বোনেরা গুলি খাচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাদের রেখে আমি কীভাবে জাহাঙ্গীরনগরে যাবো? সর্বশেষ বেলা ২ টা ৪৫ মিনিটে আবার তাকে ফোন করি। তখন সে আমাকে বলে, তুমি কেন আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছো আম্মু? আমি যদি শহীদ হই তাহলে আমার আইডি কার্ড দেখে আমাকে শনাক্ত করো। এরপর ২টা ৫৫ মিনিটের দিকে আমার হাসপাতালের ডাক্তার বললো, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, সজলকে আসতে বলো। তাকে দুই বার ফোন দিয়েছিলাম, ফোন কেটে দিয়েছে। পরে অনবরত রিং করেছি কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। পরে ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি তার সকল বন্ধু-বান্ধবকে ফোন দিয়ে বাইপাইল এলাকায় তার খোঁজ নিতে বলি। তারা বলে অনবরত গুলি হচ্ছে, আমরা খোঁজ নিতে পারছি না। আশুলিয়া থানার সামনে আমরা যেতে পারছি না। আমি নিজে খোঁজ নিতে যেতে পারিনি কারণ হাসপাতালে প্রচুর গুলিবিদ্ধ আহত লোক আসছিল।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে শাহীনা বেগম বলেন, সন্ধ্যা আনুমানিক ৭ টার দিকে হাসপাতাল থেকে আমি ছেলের খোঁজে সজলের এক বন্ধু শান্তকে নিয়ে বের হই। আমি আশেপাশে যত হাসপাতাল আছে সকল হাসপাতালে ছেলের খোঁজ করি কিন্তু পাইনি। আমি আইসিইউতে ঢুকেও রোগীদের মুখ দেখে ছেলেকে খুঁজেছি। সকল বেওয়ারিস লাশ ছিল তা আমি উল্টেপাল্টে দেখেছি। তারা আমাকে লাশ দেখতে নিষেধ করছিল কারণ তারা বলছিল আপনি মা, আপনি সহ্য করতে পারবেন না। নিহতদের মাথায়, বুকে গুলি লেগে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এগুলি দেখলে আপনি পড়ে যেতে পারেন। আমার স্বামীও বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের সন্ধানে খোঁজখবর করে, কিন্তু ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সারাদিন এবং রাত ৩ টা ৫০ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে আমি বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে বাইপাইল মোড়ে আসি। তখন আমি সেখানে লাঠিসোঁটা নিয়ে পাহারারত ছাত্রদেরকে দেখতে পাই। তাদের কাছে আমার ছেলের সন্ধান জানতে চাই এবং আমার মোবাইলে থাকা ছবি তাদেরকে দেখাই। তখন একজন ছেলে আমাকে বলে, আন্টি আপনি যদি সহ্য করতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে একটা খবর বলতে চাই। তখন আমি বললাম বাবা আমি আমার ছেলেকে পাওয়ার জন্য সকল কিছু সহ্য করতে প্রস্তুত আছি, তুমি বলো। তখন সেই ছেলেটি আমাকে বলে, আশুলিয়া থানার সামনে ৬/৭ টি ছেলেকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আপনি সেখানে আপনার ছেলেকে খুঁজে দেখতে পারেন। আমি আশুলিয়া থানায় যেতে চাইলে অন্য ছাত্ররা আমাকে সেখানে যেতে দেয়নি। তারা আমাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমি বাসায় গিয়ে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়ে ৬ টার দিকে বাসা থেকে আবার বের হই এবং সকাল আনুমানিক সাড়ে ছয়টার দিকে আশুলিয়া থানার সামনে যাই। সেখানে গিয়ে একটা পুলিশের পিকআপ গাড়িতে বেশ কয়েকটি পোড়া লাশ দেখতে পাই। অনেক মানুষ লাশগুলোর ছবি তুলছিল ও ভিডিও করছিল। আমি ভিড় ঠেলে সামনে যাই এবং একটা ছবি তুলি। আমি দেখতে পাই একটি লাশ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, পায়ের একটি মোটা হাড় উঁচু হয়ে আছে এবং সে হাড়ের সঙ্গে একটি জুতা পোড়া অবস্থায় ঝুলছে। সামান্য টাচ করলেই জুতাটা পড়ে যাবে। জুতাটা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, এই জুতাটি আমার ছেলে সজলের জুতা। (এসময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শহীদ সজলের মা। অশ্রুসিক্ত হন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত অনেকেই।)
এরপর সাহীনা বেগম বলেন, আমি তখন উপস্থিত সেনা সদস্যদের বলি, এটাই আমার ছেলের লাশ। দয়া করে আমার ছেলের লাশ আমাকে দিয়ে দিন। তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে বলেন, এখন লাশ দেওয়ার অনুমতি নেই। অনুমতি পাওয়া গেলে আপনাকে জানাবো। আমি নিরুপায় হয়ে আমার ছেলের লাশ ফেরত পাওয়ার জন্য আমার কর্মস্থলের হাসপাতালের ডাক্তারদের সহায়তা করার অনুরোধ করি। বিকাল আনুমানিক সাড়ে চারটার দিকে সজলের বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে যেখানে লাশ পোড়ানো হয়েছিল সেখানে আসতে বলে। আমি সেখানে ৫টার দিকে গিয়ে পৌঁছাই। তখন গাড়ি থেকে একটার পর একটা পোড়া লাশ নামানো হয় এবং শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে লাশের কাছে যেতে দেয়। সজলের লাশ যখন নামানো হয় তখন তার সঙ্গে তার কর্মস্থলের আইডি কার্ডের আংশিক পোড়া কার্ড এবং তার মানিব্যাগের ভিতরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড দেখে আমি আমার ছেলে সজলের লাশ শনাক্ত করি। আমার ছেলের লাশের যখন প্রথম ছবি তুলি, সেখানে আমি দেখতে পাই তার পোড়া হাতের পাশেই তার মোবাইল ফোনটি রয়েছে। এটা দেখে আমি বুঝতে পারি যে, পোড়ানোর পূর্ব মুহূর্তেও সে জীবিত ছিল এবং ফোন দিয়ে কাউকে কিছু জানানোর চেষ্টা করছিল। আমার মনে হয়েছে, যখন তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন সে প্রাণপণ তার অবস্থা আমাদেরকে জানানোর চেষ্টা করছিল বা কোনো মেসেজ লেখার চেষ্টা করছিল কিন্তু একটার উপর আরেকটা লাশ ফেলার কারণে নিচে পড়ে যাওয়ায় সে আর কোনো মেসেজ লেখা বা কল দেওয়ার সুযোগ পায়নি। আশুলিয়া রাস্তার উপরে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর গান সেলুটের পর জানাজা পড়ানো শেষে আমার ছেলেসহ চারজনের লাশ সংশ্লিষ্ট পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমার ছেলের লাশ গ্রহণ করার পর আমার কর্মস্থল হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করে। তাকে কাফন পরিয়ে কফিনের মধ্যে রেখে হাসপাতালের গাড়িতে আমার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে পৌঁছে দেয়। সেখানে ৭ আগস্ট, ২০২৪ সালে তাকে দাফন করি।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে ছেলে হারা মা বলেন, আমার ছেলে সজল সিটি ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি পড়ছিল এবং পাশাপাশি সে ‘টেস্টি ট্রিট’ নামক একটি ফুড শপে চাকরি করতো। আমার ছেলের দুই বছরের একটি কন্যা শিশু আছে। সে তার বাবার কবরের কাছে গিয়ে বাবাকে ডাকাডাকি করে বলে বাবা উঠো, বাবা উঠো। (এই সংক্রান্ত একটা ভিডিও এবং সজলকে জাতীয় পতাকা হাতে রাজপথে আন্দোলনরত থাকা অবস্থায় ধারণকৃত আরেকটি ভিডিও আদালতে প্রদর্শিত হয়)।
শহীদ সজলের মা বলেন, আমার সন্তানসহ দুই হাজার মানুষকে যারা হত্যা করেছে সেই আসামিরাসহ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইজিপি মামুন, ওবায়দুল কাদের, সাইফুল এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ লীগের বিচার চাই।
আজকে পর্যন্ত এই মামলায় নয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। আগামীকাল পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আজ প্রসিকিউটসন পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম। একসময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এছাড়া এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।