বাসস
  ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯:৫৮

সাতক্ষীরার উদ্যোক্তা মোশারফ গড়েছেন মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা

সাতক্ষীরা শহরের কাছে বিনেরপোতা বিসিক শিল্প নগরীতে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাটি অবস্থিত। ছবি: বাসস

// আসাদুজ্জামান //

সাতক্ষীরা, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): জেলার শ্যামনগর উপজেলার তরুণ উদ্যোক্তা মৌচাষী মোশারফ হোসেন। ২০০০ সালে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংগঠন থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি মাত্র ৬টি বক্সে মৌচাষ শুরু করেন।

দীর্ঘ ২৪ বছর পরে তিনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন সাতক্ষীরা শহরের কাছে বিনেরপোতা বিসিক শিল্প নগরীতে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। যার নাম দিয়েছেন মেসার্স সুন্দরবন এগ্রো। বিসিক শিল্পনগরীতে তিনি ২৯ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন দুটি প্লট। তার মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কর্মসংস্থানও হয়েছে বেশ কয়েকজনের।

তরুণ উদ্যোক্তা মোশারফ হোসেন (৩৯) সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পার্শ্বেমারী গ্রামের মো. মজিদ গাজী ও করিমন নেছা দম্পতির ছেলে। তার স্ত্রীর নাম তহমিনা বেগম (৩২)। মোশারফ ও তহমিনা দম্পতি এক মেয়ে ও এক ছেলের জনক-জননী। তাদের মেয়ের নাম তাসমিন সুলতানা মিতু (১৪) ও ছেলের নাম মাহবুবুর রহমান তামিম (১১)। বর্তমানে তিনি সাতক্ষীরা শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন।

মোশারফ হেসেনের মধু প্রক্রিজাতকরণ কারখানার অপারেটর সাদ্দাম হোসেন জানান, মধু প্রক্রিজাতকরণ মেশিনে প্রথমে ‘র’ মধু অর্থাৎ কাঁচা মধুটাকে প্রি হিটিং ও মিক্সিং চেম্বারে দেওয়া হয়। এরপর সেটা ফিল্টার হয়ে কনসানটেশন ট্যাঙ্কের মাধ্যমে ভেকুয়াম ইভাপোরেশন পদ্ধতিতে মধু থেকে জলীয় অংশ কমিয়ে মধুর ঘনত্ব বৃদ্ধি করা হয়। এরপর এটা রিজার্ভ ট্যাঙ্কে জমা হয়। তারপর ফিলিং মেশিনের মাধ্যমে বোতলজাত করা হয়। এরপর সাধারণ ভোক্তার হাতে এটা দেওয়া হয়। তিনি আরও জানান, এ মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কাজ করতে এসে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যা ভবিষ্যতে আমি কাজে লাগাতে পারবো।

মধু প্রক্রিজাতকরণ কারখানার সহকারী অপারেটর মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ জানান, আমি দীর্ঘদিন ধরে মেসার্স সুন্দরবন এগ্রোতে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় সহকারী অপারেটর হিসেবে কর্মরত আছি। এখানে আমার মতো ৫/৬ জন মানুষ কাজ করে থাকেন। এখান থেকে আমরা যে টাকা উপার্জন করি তা দিয়ে আমরা আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারি। পাশাপাশি আমাদের ছেলে মেয়েরদের লেখাপড়াও শিখাতে পারছি।

মেসার্স সুন্দরবন এগ্রো’ মালিক মোশারফ হোসেন জানান, শ্যামনগরে আমাদের প্রধান পেশা ছিল মূলত সুন্দরবন কেন্দ্রিক। রাত পোহালেই আমরা সুন্দবনে গিয়ে মাছ ও কাকড়া ধরে তা দিয়ে যে টাকা পেতাম তা দিয়ে চাল ডাল ক্রয় করে খেতাম। হঠাৎ ২০০০ সালের কোন একদিন দেখি একজন ভ্রাম্যমাণ মৌচাষী কয়েকটি বক্স নিয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছেন। তার কাছ থেকে মধু চাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে মৌচাষ শুরু করার চিন্তাভাবনা করলাম। এ সময় আমার কাছে কোনো টাকা পয়সাও ছিল না। একপর্যায়ে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংগঠন থেকে ২৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে মাত্র ৬টি মৌবক্স তৈরি করলাম। আর এ মৌবক্স নিয়ে কখনও সরিষা, কখনও লিচু, কখনো সুন্দরবনে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ মৌবক্স স্থাপন করে মধু আহরণ শুরু করি। সর্বশেষ আমি ২০০ ভ্রাম্যমাণ মৌবক্স নিয়ে মধু আহরণ করেছি।

তিনি আরও জানান, সাতক্ষীরায় অসংখ্য মৌচাষি থাকলেও এ জেলায় কোন মধু প্রক্রিজাতকরণ মেশিন না থাকায় মধু ব্যবসায়ীরা সঠিক বাজার মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। এছাড়া ‘র’ মধুতে প্রচুর পরিমাণে ময়লা আবর্জনা ও জলীয় অংশ থাকায় এ মধু বেশিদিন রাখা যেতো না এবং উৎপাদিত মধু বাজারজাতও ঠিকমত করা যেতো না। 

এক পর্যায়ে আমার মাথায় আসে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের। এরপর আমি ভ্রাম্যমাণ মৌবক্সে মধু আহরণ ছেড়ে দিয়ে সাতক্ষীরা শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে মধু প্রক্রিজাতকরণ মেশিন স্থাপন করি। পরে সেখান থেকে বিনেরপোতা বিসিক শিল্প নগরীতে ২০২০ সালে প্রথমে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে সাড়ে ৪ হাজার স্কয়ার ফুট একটি প্লট ক্রয় করে সেখানে মধু প্রক্রিজাতকরণ মেশিনটি স্থানান্তর করে সেখানে মেসার্স সুন্দরবন এগ্রো নামে প্রতিষ্টান গড়ে তুলি। আমার এ কারখানা থেকে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ব্যবসায়ীরা এ মধু রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে এবং বিদেশে সরবারহ করছেন। যা দিয়ে তারা প্রচুর লাভবানও হচ্ছেন।

তিনি জানান, আমার এ কারখানায় প্রতিদিন গড় এভারেজ এক মেট্রিকটন মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। আর এ থেকে আমি ১২ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। সব খরচ বাদ দিয়ে এতে আমার ৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। আমার এ উপার্জিত অর্থ দিয়ে ২০২০ সালে বিসিক শিল্প নগরীতে ১১ লাখ টাকা দিয়ে ৩ হাজার স্কয়ার ফুটের আরো একটি প্লট ক্রয় করেছি। এ প্লটে আরো একটি প্রতিষ্ঠান করার জন্য আমার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সেখানে ঘানি ভাঙানো খাঁটি সরিষার তেল, ঢেঁকিছাটা লালচাল, নারকেল তেল ও বিভিন্ন মসলা তৈরি করা হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপ-ব্যবস্থাপক গৌরব দাস জানান, বিসিক শিল্প নগরীতে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোকে বিসিকের পক্ষ থেকে ঋণ প্রদানসহ শিল্পনগরীরর মধ্যে রাস্তাঘাট ও বিদূুতসহ যেকোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদানে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা হয়।

তিনি আরও জানান, বিসিক শিল্প নগরীর মধ্যে মেসার্স সুন্দরবন এগ্রোর মালিক মোশারফ হোসেন মধু প্রক্রিয়াজাত কারখানা স্থাপন করে অল্প দিনের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন।