শিরোনাম
আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : হোগলা পাতার দড়িতে স্বচ্ছলতার স্বপ্ন বুনে চলেছেন জেলা সদরের চর সামাইয়া গ্রামের হতদরিদ্র নারীরা। এক সময় অন্যের বাড়ীতে গৃহকর্মীর কাজ করাই ছিল যাদের একমাত্র পেশা। তারা এখন স্বচ্ছল,স্বনির্ভর। ভাগ্যবদলের সংগ্রামে নেমে দিনমজুরী ছেড়ে দিয়েছেন। জরাজীর্ণ কুঁড়ে ঘরের বদলে থাকছেন টিনের ঘরে। জীবন ধারনের দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটিয়ে সন্তানদের লেখা পড়া করাচ্ছেন স্কুল কলেজে। পরিশোধ করছেন এনজিওর কিস্তি আর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ধারদেনা। এখন স্বচ্ছলতায় ভরা তাদের জীবন। দেখছেন নতুন দিনের স্বপ্ন। শুধু হোগলা পাতার দড়ি বানিয়েই বদলে গেছে তাদের জীবন।
জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে খেয়াঘাট ছাড়িয়ে আরও কয়েক কিলোমিটার গেলেই চর সামাইয়া গ্রাম। এক সময় এখানকার নারীরা- অন্যের বাড়ীতে গৃহকর্মীর কাজ করে, কেউবা ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় জড়িত থাকলেও এখন তা আর নেই। সেইসব পেশা ছেড়ে এখন তারা উদ্যোক্তা। তারা কাজ করে খায়। ক্ষুদ্র শিল্প বদলে দিয়েছে তাদের জীবনধারা। সংসারের কাজকর্ম করেও হোগলাপাতার দড়ি বানিয়ে উপার্জন করছেন বাড়তি টাকা।
সরেজমিন চরসামাইয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার নারীদের বড় একটি অংশ শুকনা হোগলা পাতাকে পানিতে ভিজিয়ে নরম করে চুলের বেনীর মত মুড়িয়ে মুড়িয়ে তৈরি করেন দড়ি। সপ্তাহে সপ্তাহে বেপারীরা ও আড়ৎদাররা তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে ঢাকার বিভিন্ন শিল্প কারখানায় পাঠান। এসব কারখানায় হোগলা পাতার দড়ি দিয়ে তৈরি হয় মোড়া, চেয়ার, কলস, জগ, ফুলদানি, ব্যাগসহ নানা রকমের আসবাবপত্র ও শো-পিস। এসব পণ্য রপ্তানি করা হয় বিদেশেও। এ শিল্প এখন চরসামাইয়া গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী আলীনগর, ভেদুরিয়া ও ভেলুমিয়া নামক ইউনিয়নগুলোতেও। এখানকার সহস্রাধিক নারী ও স্কুল কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা হোগলা পাতার দড়ির শিল্পে কাজ করে এখন তারা এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন।
চরসামাইয়া গ্রামের বাসিন্দা রফিক, রিয়াজ, রহিম, ফয়েজ, লালু মিয়া, কামরুল ব্যাপারীর সাথে কথা হয়। তারা জানান, চরাঞ্চল থেকে হোগলা পাতা এনে তারাই নারী শ্রমিকদের হাতে তুলে দেন। নারীরা বাড়িতে বসেই দড়ি তৈরি করেন। প্রতি ১০০ হাত দড়ি তৈরির মজুরি ১৪ টাকা। এসব দড়ি ২০ টাকা দরে সাভার ও গাজীপুরে সাপ্লাই দিচ্ছেন তারা। এতে ভাল আয় হচ্ছে তাদের। দিনদিন হোগলা পাতার দড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দড়ি বানাতে উৎসাহিত হচ্ছেন গ্রামের নারীরা। এতে গ্রামগুলোতে অভাবও কমে এসেছে।
চরসামাইয়া গ্রামের ত্রিশোর্ধ্ব নারী আইনুর বেগম বলেন, ‘দড়ির কাজ আছে দেইখাই অন্যের বাড়িতে বুয়ার কাজ করা ছাইরা দিছি। দড়ি বিক্রি করে মাসে ৭/৮ হাজার টাকা রোজগার করি। তা দিয়া খাওন খরচ, কাপড় চোপড়, সন্তানদের স্কুলের খরচ এবং এনজিওর কিস্তি দিয়া আল্লাহ সুখেই রাখছে এহন।’
তবে পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরী যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন নারী উদ্যোক্তা নুরজাহান (৩২)। তিনি বলেন, আমরা যদি আর একটু বেশি মজুরি পাইতাম তবে সব কাজ ফালাইয়া দড়ি বানাইতাম। এক আঁটি দড়ি বানাইতে অনেক কষ্ট। এক আঁটিতে ৬৫০ টাকা দেয়।
একই গ্রামের উদ্যোক্তা ৩৩ বছর বয়সী নারী ফাতেমা বেগম বলেন, ক্ষুধার জ্বালায় শহরে বড়লোকদের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে সংসার চালাতাম। স্বামী অসুস্থ থাকায় তিন মেয়ে নিয়ে আমার কষ্টের সীমা ছিলনা। হোগলা পাতার দড়ি বানিয়ে তা বিক্রি করে আমি এখন স্বাবলম্বী। এভাবেই আইনুর, নুরজাহান আর ফাতেমাদের মতো বহু নারী হোগলাপাতার দড়িতে ভাগ্যবদল করে এখন নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর।
উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে হোগলার দড়ি সংগ্রাহক ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন,‘ আমরা দাঁদন দিয়া চর রাহি,পাতা কাটি রোইদে সুখাইয়া মহিলাদের দেই। তাদের প্রতি আঁটিতে ৬৫০ টাকা দেই। এ দড়ির তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা দেশের সবখানেই রয়েছে। এখানে তৈরি করে সরাসরি বিদেশে পাঠানো গেলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেত।
ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বেপারী বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন এলাকার পাতার মালিকদের অগ্রীম টাকা দিয়ে চর রাখি। সেই চরের কাঁচা পাতা কেটে রোদে শুকিয়ে শ্রমিকদের দেই। তারা দড়ি বানিয়ে আমাদের দেয়। প্রতি ১শ' হাত দড়ি ১৪ টাকা দরে ক্রয় করি। এই দড়ি আমরা ঢাকার সাভার ও গাজীপুরে কুটির শিল্প তৈরির কোম্পানির কাছে পাঠাই। তাদের কাছে প্রতি ১শ' হাত ২০টাকা দরে বিক্রি করি। অনেক আগে কিছু শ্রমিককে ঢাকায় নিয়ে বিভিন্ন শো-পিস তৈরির কাজ শিখাইছি। কিন্তু বিদেশে রপ্তানির সুযোগ এখনো আমরা পাই নাই। যদি সরকার অথবা পুঁজি বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা পাই তবে ভোলায় রপ্তানিমূখী কুটিরশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। এখান থেকে সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সহ প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।’
এ ব্যাপারে ভোলা বিসিক শিল্পনগরীর উপ-পরিচালক মোঃ সোহাগ আহাম্মদ বাসস'কে বলেন, ভোলায় হোগলা পাতা দিয়ে দড়ি তৈরি করা হয়। এর পাশাপাশি হোগলাপাতা দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। এতে করে গ্রামের অনেক মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। আমি সরেজমিনে অনেক জায়গা পরিদর্শন করেছি, তাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের মতামত জেনেছি।
তিনি বলেন, এখানে বিশাল সম্ভাবনার খাত এটা। এখানে যারা জড়িত রয়েছে বা যে সকল উদ্যোক্তা আছে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বিনিয়োগের পরিমাণটা বাড়ালে দেশের মধ্যে বড় একটা বাজার তৈরি করা সম্ভব। এ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আমরা দড়ি তৈরির বিষয়টি অবগত আছি। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দড়ি ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি।
এ ব্যাপারে ভোলার জেলা প্রশাসক মো: আজাদ জাহান বাসস'কে জানান, ভোলার তৃণমূলের নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তাদের পাশে সরকারের সহায়তার হাত সবসময়ই প্রশস্ত রয়েছে। জেলা সদরে ভোলার বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের বহু পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।