ঢাকা, ১৭ জুন, ২০২৫ (বাসস) : চৌদ্দ বছরের কিশোর নাহিদ। যে বয়সে স্কুলে ও খেলার মাঠে থাকার কথা, সে বয়সে জীবন-জীবিকার তাগিদে সে টেম্পুর হেলাপার। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থেকে ডেমরা। ভোর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিরামহীন ডিউটি। ধূলাবালি মধ্যেই তার কর্মজীবন। শব্দ দূষণ ও বায়ূ দূষণের মধ্যেই কাটছে তার শৈশব-কৈশোর।
গত সপ্তাহে নাহিদ ডিউটিতে আসেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাহিদের শ্বাসকষ্ট ও কাঁশি হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন অতিরিক্ত ধুলাবালিতে দীর্ঘদিন থাকায় তার এ রোগ হয়েছে।
৩৯ বছর বয়সী বিধবা রেশমা। খুলনায় তামাক কারখানায় চাকরি করেন। তামাকের গন্ধ ও তামাক গুঁড়োর ধুলায় প্রায় অসুস্থ থাকেন রেশমা। হাঁপানি ও স্বাসকষ্ট তার নিত্যদিনের সমস্যা।
রেশমা জানান, 'স্বামী মারা যাওয়ার পর ২ সন্তান নিয়ে আর বিয়ে করিনি। জীবিকার তাগিদে সহজে কাজ পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে এই তামাক কারখানায় কাজ নিয়েছি। এ কাজ করতে গিয়ে এখন আমি মৃত্যু পথযাত্রী।'
শুধু এ নাহিদ ও রেশমা নয়। দেশজুড়ে হাজার হাজার নারী ও শিশু বায়ু দূষণের শিকার। কেউ কর্ম ক্ষত্রে, কেউ পথচলতে। বায়ূ দূষণ সব বয়সী নারী-পুরুষকেই আক্রান্ত করে। তবে বেশি আক্রন্ত হয় শিশু ও বয়স্ক নারীরা।
শিল্প কারখানা, যানবাহন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং নগরায়ন বায়ু দূষণের কয়েকটি প্রধান কারণ। নানা কারণে বায়ু দূষণ ঘটে, যার অনেকগুলোই মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। মরু অঞ্চলে ধুলোঝড় এবং বন-জঙ্গলে, আবাদি জমিতে বা ঘাসে আগুন লাগার ফলে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে রাসায়নিক ও ধুলিকণাজনিত দূষণ ঘটিয়ে থাকে।
ক্ষতিকারক পদার্থ বাতাসে মেশার ফলে বায়ু দূষণ হয়। বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যরে ক্ষতি হয়, পরিবেশ এবং সম্পদও নষ্ট হয়। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে জলবায়ুর ওপর এবং তা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনেরও কারণ হয়।
বিশ্বব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি : নিউ ইভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি বছর উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে আনুমানিক ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে মানুষের শ্বাসযন্ত্র, যার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, কাশিসহ নানা জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণে বছরে জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ। এতে ঢাকা ও সিলেটের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বহিরাঙ্গন বায়ুদূষণের প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ২৬৯ পিপিএম বায়ুমান অনুযায়ী ঢাকা আবারও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এই মাত্রার দূষণ হলো বাতাসের মান ‘অস্বাস্থ্যকর’।
এ ছাড়া, চীনের উহান ও ভারতের নয়াদিল্লি যথাক্রমে ২৫২ ও ২১৪ একিউআই বায়ুমান নিয়ে এ তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
কার্বন মনোক্সাইড: পেট্রোল, ডিজেল ও কাঠসহ নানা ধরনের কার্বন-যুক্ত জ্বালানি আধপোড়া হলে এই রঙবিহীন গন্ধবিহীন গ্যাসটি তৈরি হয়।
সিগারেট পোড়ালেও এই গ্যাস বের হয়। এই গ্যাস আমাদের রক্তে অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এই গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় আমাদের প্রতিবর্তী ক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সবসময় ঝিমোনোর ভাব আসে। বিভিন্ন ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতারও শিকার হতে হয়।
কার্বন ডাইঅক্সাইড: মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের ফলে নির্গত প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস। কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ফলে নির্গত হয়।
ক্লোরোফ্লুরোকার্বন : মূলত রেফ্রিজারেটর ও এয়ারকন্ডিশনিং মেশিন থেকে এই গ্যাস নির্গত হয়। বাতাসে এই গ্যাস নির্গত হওয়ার পরে স্ট্র্যাটেস্ফিয়ারে চলে যায়, সেখানে অন্যান্য গ্যাসের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির বিকিরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বাভাবিক ক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
লেড বা সিসা : এই পদার্থটি লেড ব্যাটারি, পেট্রোল, ডিজেল, হেয়ারডাই, রঙ প্রভৃতি পণ্যে পাওয়া যায়। সিসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের ক্ষতি করে থাকে। এটির প্রভাবে হজমের প্রক্রিয়া ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে ক্যানসারও হতে পারে।
ওজোন : ওজোন বায়ুম-লের উচ্চস্তরে পাওয়া যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসের চাদর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ থেকে পৃথিবীকে বাঁচায়। কিন্তু মাটির কাছাকাছি এই গ্যাস অত্যন্ত বিষাক্ত ধরনের।
মাটির কাছাকাছি যে ওজোন পাওয়া যায় তা মূলত কলকারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত হয়। ওজোনের প্রভাবে চুলকানি হয়, জ্বালা করতে পারে। ওজোনের প্রভাবে ঠাণ্ডা লাগার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
নাইট্রোজেন অক্সাইড : এই গ্যাসের প্রভাবে ধোঁয়াশা তৈরি হয় এবং অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। পেট্রোল, ডিজেল, কয়লার মতো জ্বালানি পোড়ানোর ফলে এই গ্যাস নির্গত হয়। নাইট্রোজেন অক্সাইডের প্রভাবে বাচ্চাদের শীতের সময় সর্দিকাশি হতে পারে।
সাসপেনডেড পার্টিকুলার ম্যাটার: ধোঁয়া, ধুলো, বাষ্প এবং একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে বাতাসে ভেসে থাকা কঠিন পদার্থের কণাকে এসপিএম বলে। এটি বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। ধোঁয়াশার একটা অন্যতম কারণ এসপিএম।
এসপিএম বেশি থাকলে দূরের জিনিস দেখার ক্ষেত্রে খুব অসুবিধা হয়। এই ধরনের পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা ফুসফুসে প্রবেশ করে শরীরের এই অন্যতম প্রধান অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি করে।
সালফার ডাইঅক্সাইড : মূলত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা পোড়ানোর ফলে এই গ্যাস নির্গত হয়। অন্যান্য শিল্পজাত প্রক্রিয়ার ফলেও এই গ্যাস নির্গত হয়। যেমন, কাগজ উৎপাদন পদ্ধতিতে, ধাতু গলানোর ক্ষেত্রে ইত্যাদি। এই গ্যাস অ্যাসিড বৃষ্টি এবং ধোঁয়াশা সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ। এর প্রভাবে ফুসফুসের নানা ধরনের জটিল রোগ হয়।
বায়ুদূষণের মূল উপাদানসমূহ এবং তাদের প্রধান উৎস-
কার্বন ডাই-অক্সাইড : পরিবেশের নেসেসারি ইভিল এই গ্যাসীয় উপাদানের অতিরিক্ত উপস্থিতি ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। মূলত গ্রিনহাউজ এফেক্টের ফলে এটি হয়ে থাকে। কলকারখানা, যানবাহনই এই গ্যাসের প্রধান উৎস
কার্বন মোনো-অক্সাইড : মানুষের শ্বাসক্রিয়ার পক্ষে চূড়ান্ত ক্ষতিকারক। এই গ্যাস বায়ুম-লের গ্যাসীয় ভারসাম্যের বিঘ্ন ঘটাতে পারদর্শী। মূলতঃ পুরনো যানবাহনের থেকে এই গ্যাসের উৎপত্তি। এই কারণে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন দূষণ-নিয়ন্ত্রণজনিত বিধি লাগুন করা হয়েছে। ইউরো স্টেজ এবং ভারত স্টেজ (ইঞ্জিন-এর রেটিং ব্যবস্থা) এই ধরনের দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
সালফার ডাই-অক্সাইড : ট্যানারি এবং অন্যান্য কলকারখানার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ার অন্যতম মূল উপাদান হল এ গ্যাস। বাতাসের ভাসমান জলীয় বাষ্পের সাথে মিশে গিয়ে এই গ্যাস অতি ক্ষতিকারক অ্যাসিড বৃষ্টি ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। মানুষের ক্ষতির পাশাপাশি তাজমহলের মতো মার্বেল-নির্মিত সৌধের-ও অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়েছে এর কারণে।
ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন : মূলত পুরোনো এয়ার কন্ডিশনার এবং বাণিজ্যিক সিলিন্ডার এর উৎস। পৃথিবীর ওজোনোস্ফিয়ার বা ওজোন স্তর লঘুকরণের অন্যতম উপাদান এটি। কিন্তু বর্তমানে এই গ্যাস ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হয়েছে প্রায় সব দেশেই। প্রকৃতপক্ষে, এই ফ্লুরো কার্বন পরিবারের কোনো গ্যাস-ই আর তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না।
অন্যান্য সোনার কারখানাতে ব্যবহৃত নাইট্রিক অ্যাসিড জনিত গ্যাস যেমন নাইট্রোজেন মোনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি, প্রায় সব কারখানাতেই ব্যবহৃত সালফারের যৌগ, ক্লোরিনের যৌগ ইত্যাদি থেকে উদ্ভূত গ্যাসগুলিও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে পরিগণিত করা যেতে পারে।
তবে বর্তমানে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে বায়ুদূষণ বৃদ্ধির হারে লাগাম পরানো গেছে।
যানবহন বা জ্বালানি থেকে নির্গত ধোঁয়ার মধ্যে যে কার্বন কণা থাকে, তার আকার ১০ ন্যানোমিটার থেকে কম হয়। এগুলি বাতাসে ভেসে থাকে এবং বাতাসে মধ্যে কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। এটি একটি বিশেষ কারণ।
বর্জ্য, ধুলাবালি, অপরিচ্ছন্নতা, কলকারখানার ধোঁয়া ইত্যাদি বিভিন্নভাবে বায়ু দূষিত হয়। বায়ুদূষের কারণে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন সংক্রমণ হয়। এ সব সমস্যার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডা. মো. মোজাহেরুল হক বলেছেন, সুন্দর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের অনেক রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
কারণ, এই বর্জ্যটাইতো বাতাসকে দূষিত করছে। এই দূষিত বাতাসের মধ্যেও যে রোগ সংক্রমণের উপাদান থাকা দরকার সেগুলো সব আছে। যে কারোই এ থেকে শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে।
এই আবর্জনা আমাদের যেমন খোলা অবস্থায় ফেলতে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, পাশাপাশি এটি পরিষ্কার করার দায়িত্ব যাদের তাদেরও কিন্তু ভোরের আগেই পরিষ্কার করে নিয়ে যাওয়া উচিত। তবে সেটি হচ্ছে না।
আমরা যদি এই ব্যবস্থা করতে পারি যে ভোরের আগেই একে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে, পাশাপাশি যেসব জায়গায় স্যুয়ারেজ খোলা সেগুলো যদি আমরা সিল করে বন্ধ করে দিতে পারি, তাহলে অনেক রোগ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারি।
আমরা যেটি দেখছি, উন্নয়ন হচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই উন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের কতখানি ক্ষতি হচ্ছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কতটা বাড়ছে- সেটি কিন্তু দেখা দরকার।
বায়ুদূষণে ধুলার যে দূষণটি সেটি খুব সহজে বন্ধ করা যায়। কারণ কন্সট্রাকশন তো হতেই থাকবে। এটা আমরা নিজেরাও করি, সরকারও করে। সুতরাং এটি থাকবে।
আগে যেটা আমরা দেখেছি, মিউনিসিপালিটির কিছু গাড়ি ছিল। এই গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো হতো। গাড়িটা চলে যেত, পানিতে রাস্তা ভিজিয়ে দিত। এটা ধুলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটা অনেকটা নিরাপদ বাতাস আমাদের দিতে পারত। এটি করা উচিত বলে আমি মনে করি।