পরিবেশবান্ধব বাঁশ শিল্প বাঁচাতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর সুপারিশ

বাসস
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৩:৪৫
লালমনিরহাট জেলা সদরের বড়বাড়ীহাটে বাঁশের তৈরি পণ্যের নিয়মিত হাট বসে। ছবি : বাসস

।। বিপুল ইসলাম ।।

লালমনিরহাট, ৩ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : প্লাস্টিকের দাপটে যখন একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় হস্তশিল্প, তখনও  জেলা সদরের বড়বাড়ীহাটে বাঁশের তৈরি পণ্যের হাট বসে নিয়মিত। এখানে এখনো টিকে আছে শেকড়ের শিল্প বাঁশের তৈরি ডালা, কুলা, চালন, পলো, ঝাঁপি, কবুতরের খাঁচা, মাছ ধরার ডাইরসহ নানা পণ্য। এসব পণ্যে মিশে আছে গ্রামীণ জীবনের গভীর অনুভব, ইতিহাস ও সংস্কৃতি।

সদর উপজেলায় হাট বসে সপ্তাহে দুই দিন। বুধবার ও শনিবার। সকাল থেকেই বাঁশজাত পণ্যের কারিগর ও ব্যবসায়ীরা জড়ো হন হাট চত্বরে। সাজিয়ে রাখেন তাদের হাতে তৈরি বাহারি পণ্য। প্রতিটি জিনিস যেন গ্রামীণ জীবনের এক একটি প্রতিচ্ছবি।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাঁশের পণ্য তৈরি করছেন প্রবীণ কারিগর সালাউদ্দিন মিয়া। বাসসের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আগে শুধু এই কাজ করেই সংসার চলত। এখন কষ্ট অনেক বেড়েছে, আয় কমে গেছে। তবু এই পেশা ছাড়তে পারি না। এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা।’

তরুণ বিক্রেতা আসিফ হোসেন বলেন, ‘প্রতি হাটে ১০-১২ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়। লাভ থাকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। কিন্তু এখন বাঁশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে, দামও বেড়েছে। তাই অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।’

হাটের ইজারাদার আলমগীর হোসেন জানান, ‘পাঁচ-ছয় বছর আগেও হাটে ৫০টির বেশি বাঁশ পণ্যের দোকান ছিল। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০-২৫টিতে। বিশেষ করে তরুণেরা এই পেশায় আসতে না চাওয়ায় দোকানের সংখ্যা কমছে।’

বাঁশজাত পণ্যের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় টিকে থাকতে কঠিন সংগ্রাম করতে হয় ব্যবসায়ীদের। হাট ঘুরে দেখা যায়, ডালির দাম ৮০ থেকে ১৫০ টাকা, ঝাঁপি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, কবুতরের খাঁচা ১২০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা, মাছ রাখার ডাইর ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং হাতপাখা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৪০ টাকায়।

স্থানীয় ক্রেতা জাকির হোসেন বাসসকে বলেন, ‘এই পণ্যগুলো আমাদের গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

গ্রামে এখনও চালন, ডালি ছাড়া চলে না। কিন্তু আগের মতো সহজে পাওয়া যায় না।’

এ বিষয়ে স্থানীয় শিক্ষক বিপ্লব রায় বলেন, ‘বাঁশশিল্প কেবল ঐতিহ্য নয়, এটি একটি পরিবেশবান্ধব জীবনধারার প্রয়োজনীয় উপকরণ। প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি সহায়তা বাড়াতে হবে।’

স্থানীয় উদ্যোক্তারা মনে করেন, বাঁশ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তাদের মতে, প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন, অনলাইনভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থার বিস্তৃতি, রফতানিমুখী পরিকল্পনা এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে একটি নির্ভরযোগ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, যাতে বাঁশের কাঁচামাল সহজে ও নিয়মিতভাবে পাওয়া যায়।

বড়বাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা লিমন বলেন, ‘এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি পরিবার এখনও ধরে রেখেছে তাদের পূর্বপুরুষের পেশা, সংস্কৃতি ও জীবনের গল্প। প্রতিটি বাঁশ পণ্যের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে এক একজন কারিগরের নিপুনতা, সময় আর ভালোবাসা। বাঁশশিল্প কেবল একটি অর্থনৈতিক পণ্য নয়, এটি গ্রামীণ জীবনের এক জীবন্ত ইতিহাস। তাই ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) লালমনিরহাটের উপব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম এ প্রসঙ্গে বাসসকে বলেন, ‘আমরা সব সময় বাঁশ শিল্পে যুক্ত উদ্যোক্তাদের পাশে আছি। যারা এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী, তাদের খুঁজছি। আমরা তাদের প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ, বিপণনসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছি। এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’

সংশ্লিষ্টদের মতে, যেখানে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে গরু দিয়ে হালচাষ, কাঁসা-পিতলের বাসন কিংবা মাটির হাঁড়ি-পাতিল, সেখানে বাঁশশিল্প এখনো শেকড় আঁকড়ে বেঁচে আছে। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এখনই প্রয়োজন নীতিগত সহায়তা, সামাজিক সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টার সাথে চীনা রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
অগ্নিকাণ্ডের পর পুনরায় খুলে দেওয়া হল স্পেনের ঐতিহাসিক মসজিদ ক্যাথেড্রাল
কার্নিশে ঝুলে থাকা ছাত্রকে গুলির মামলায় অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্র্যাইব্যুনাল
ভয়াবহ ধসের পর চিলির তামার খনি পুনরায় কার্যক্রম শুরু করবে
লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থানে বিস্ফোরণে ৬ সৈন্য নিহত
বাগেরহাটে টিসিবি’র পণ্য বিক্রি শুরু
গাজায় যুদ্ধ সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে তেল আবিবে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ
দিনাজপুর জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন পরিদর্শনে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের পরিচালক 
কুড়িগ্রামে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
টাঙ্গাইলে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা
১০