খুলনা, ৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জেলার রূপসায় ইট ভাটার ব্যবসার আড়ালে কয়েকশ’ মানুষের কাছ থেকে ৫০ কোটিরও বেশি অর্থ নিয়ে আত্মগোপন করেছেন গোলাম সারোয়ার হাওলাদার ওরফে সরোয়ার নামে এক ব্যবসায়ী।
সরোয়ার স্থানীয় মেসার্স ফারুক ব্রিকস নামক ইট ভাটার মালিক। এমনকি তিনি খুলনা মহানগরীর হাজী মহসিন রোডের আবু খান লেনের আলীশান বাড়িটিও প্রায় ৮ কোটি টাকায় বিক্রি করে এক রাতেই পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেছেন। একই সঙ্গে তার ম্যানেজার শহীদ মীরও এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, ব্যবসায়ী সরোয়ারের পালিয়ে যাওয়ার খবরে ইট ভাটায় বিনিয়োগকারী অনেকে কষ্টার্জিত অর্থ হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন রূপসার নৈহাটী ইউনিয়নের জয়পুর, নিকলাপুর, তালিমপুর, শ্রীরামপুর, নেহালপুর, কিসমত খুলনাসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বিনিয়োগকারীরা। তারা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য পথে পথে ঘুরছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফারুক ব্রিকস এর মালিক মো. গোলাম সরোয়ার হাওলাদারের সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা অগ্রিম ইট ক্রয় কিনে ব্যবসা করে আসছেন। দিনমজুর, চাকুরিজীবী, প্রবাসী ও মধ্যম আয়ের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ সামান্য আর্থিক স্বচ্ছলতার আশায় কষ্টার্জিত নগদ টাকা ফারুক ব্রিকসের অনুকূলে অগ্রিম ইট ক্রয় বাবদ বিনিয়োগ করেন। কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়িক লেনদেন ও সময়মত পাওনা পরিশোধ করায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরো বেশি আস্থাশীল হন পাওনাদাররা।
যার ফলশ্রুতিতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষও এই প্রতিষ্ঠানের সুনামের কথা শুনে পরিচিতজনদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন। যার সুযোগে গোলাম সরোয়ার অল্প দিনের মধ্যেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। জনগণের নিকট থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা গোলাম সরোয়ার হাওলাদার ভোগবিলাসী আর অহংকারী হয়ে পড়েন।
সূত্র জানিয়েছে, গত তিন চার বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের পাওনা অর্থ সময়মত সঠিকভাবে পরিশোধে নানা অজুহাত দেখাতে শুরু করেন সরোয়ার। ফলে তার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দিন দিন কমতে থাকে এবং বিনিয়োগকারীরা তাদের পাওনা পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে গোলাম সরোয়ার নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। মোবাইলসহ সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা কোনো উপায় না পেয়ে গোলাম সরোয়ারের অন্যতম বিশ্বস্ত ও সহযোগী ফারুক ব্রিকস এর ম্যানেজার শহিদের স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু ম্যানেজার শহিদের দাম্ভিকতা ও আচরণ বিনিয়োগকারীদের আশাহত ও মর্মাহত করে। এক পর্যায়ে ম্যানেজার শহিদও গাঁ ঢাকা দেন।
ম্যানেজারকে না পেয়ে ভূক্তভোগী মানুষগুলো কষ্ট আর হতাশা নিয়ে বারবার গোলাম সরোয়ারের পৈত্রিক বাড়ি রুপসা আর খুলনা শহরের বাড়িতে অসহায়ের মত ঘুরতে থাকেন।
সর্বশেষ গেল ঈদুল আযহার ছুটির সুযোগে গোলাম সরোয়ার গোপনে খুলনা শহরের হাজী মহসিন রোডস্থ তার বহুতল বিশিষ্ট বাড়িটি বিক্রি করে আত্মগোপনে চলে যান। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই পাওনাদারদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ভুক্তভোগী মানুষের আহাজারি, চোখের পানি আর কষ্টে ভারি হয়ে ওঠে।
ফারুক ব্রিকস্ এর নিকট ক্রয়কৃত অগ্রিম ইট ও সমুদয় পাওনা না পাওয়ায় রূপসা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর ভুক্তভোগী জনগণের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ করেছেন আলহাজ মো. নাজমুল হোসেন, মো. জাকির হোসেন, মো. আবু বকর, মো. মুজিবর রহমান, এম আব্দুল্লাহ, মো. রকিবুল ইসলাম, মো. আশরাফুল হক তারেক ও মুক্তা আক্তার। এছাড়া পৃথকভাবে বিনিয়োগকারীরা রূপসা থানা, খুলনা জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক ও নৈহাটী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিকটও অনুলিপি প্রদান করেছেন।
এদিকে পাওনা টাকা পরিশোধ না করার ফলে নৈহাটী ইউনিয়নের কিসমত খুলনা আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে সরোয়ারের বড় ভাই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম রসুল হাওলাদার ও তার ভাই গোলাম সরোয়ারের কিসমত খুলনা এলাকার নিজ বাড়ির গেট ভেঙ্গে প্রবেশ করে চারটি ট্রলি, তিনটি পিকআপ এবং গাড়ির গ্যারেজ থেকে মেশিনারিসহ বিভিন্ন মালামাল পাওনাদাররা তাদের জিম্মায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় গোলাম সরোয়ারের বোন খাদিজা পারভীন রূপসা থানায় ৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এছাড়া গোলাম রসুল হাওলাদারের যেখানে যে সম্পদ রয়েছে সেই সম্পদের ওপর পাওনা টাকার বিনিময়ে প্যানা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং প্যানায় লেখা হয়েছে গোলাম সরোয়ারের এই সম্পত্তি পাওনাদাররা দায়বদ্ধ।
শ্রীরামপুর এলাকার পাওনাদার মো. আব্বাস আলী বলেন, ব্যবসায়ী লেনদেনের জন্য সরোয়ারকে ৫৭ লাখ টাকা প্রদান করি। তার বিনিময়ে সরোয়ার আমার কাছে ব্যাংকের চেক জামানত রাখেন। এছাড়া রুপসার নেহালপুর, শ্রীরামপুর, নৈহাটী, নিকলাপুর, কিসমত খুলনা, ইলাইপুর, আমদাবাদসহ উপজেলার এমন কোনো লোক নেই যে তার কাছে টাকা পাবে না। পাওনাদাররা প্রশাসনের মাধ্যমে যাতে টাকাগুলো পেতে পারেন সেই দাবি জানান তিনি।
পাওনাদার মৃত মো. জহুরুল শেখের পক্ষে তার ছেলে ফেরদৌস বলেন, সরোয়ারের কাছে তার ২২ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। প্রতি বছর তাকে টাকা দিতাম এবং তিনি ইট বিক্রি করে আমাকে টাকা দিত। আমি সংসার চালাতাম। ইতোমধ্যে সে পালিয়েছে। সকল পাওনাদারের টাকা ফেরতের দাবি জানান তিনি।
পাওনাদার মো. হাসান রশিদ বলেন, ২০২১ সালের দিকে সরোয়ারের কাছে ৮ লাখ টাকা রেখেছিলাম। বিনিময়ে তার ইট দেওয়ার কথা ছিলো। ইটও দেয়নি, ইট বিক্রি করে টাকা দেওয়ার কথা ছিলো সেটিও দেয়নি। টাকা চাইতে গেলে ম্যানেজার শহীদ ও ভাটার মালিক দুর্ব্যবহার করে।
এদিকে, এ ঘটনায় গত ৩ জুলাই রূপসা উপজেলা পরিষদের সামনে পাওনাদাররা টাকা ফেরতের দাবিতে ভাটার মালিক গোলাম সরোয়ার হাওলাদার ও তার ম্যানেজার শহীদ মীরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন।
মানববন্ধন শেষে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর ভুক্তভোগীরা স্মারকলিপিও প্রদান করেন।
অভিযোগ উঠেছে, ভাটার ম্যানেজার শহীদ মীর কোনো হিসাব-নিকাশ পাওনাদারদের বুঝিয়ে না দিয়ে সে আরো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এমনকি এই শহীদ ভাটা কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেই ইট বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছে বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। শহীদ বর্তমানে দ্বিতীয় বিয়ে করে খুলনায় ফ্লাট কিনে নতুন দাম্পত্য জীবন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে রূপসা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, অর্থ আত্মসাৎ করে ইট ভাটার মালিক গোলাম সরোয়ার ও তার ম্যানেজার শহীদ আত্মগোপনে যাওয়ার ঘটনায় বিনিয়োগকারীরা মানববন্ধন করেছেন। অনেকে থানায় লিখিত অভিযোগও করেছেন।
পাওনাদারদের কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি জানান, গত ১৭ মার্চ গোলাম সরোয়ার বিদেশে যাওয়ার জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে আবেদন করে। কিন্তু বিষয়টি আমার সন্ধেহ হলে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আটকে দেওয়া হয়। তবে আমি নিশ্চিত সে বাংলাদেশেই রয়েছে।