মো. আয়নাল হক
রাজশাহী, ৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জেলায় ফজলি আমের ব্যবসা এখন তুঙ্গে। সম্প্রতি আম সংগ্রহের মৌসুম শেষ হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় বাজারগুলোতে ব্যাপক ব্যস্ততা ও অনলাইন বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
ফজলি ও আম্রপালির মতো জনপ্রিয় জাতের আমে বাজার ভরে গেছে আর দামও বাড়ছে। দেশের প্রধান আম উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর নিয়ে রাজশাহী অন্যতম।
পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর গ্রামের আম চাষি মতিউর রহমান জানান, গত এক সপ্তাহে ফজলির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এর দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
সোমবার বানেশ্বর বাজারে প্রতি মণ ফজলি আম ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগের দিনের চেয়ে মণ প্রতি ১০০ টাকা বেশি।
তিনি আরো জানান, গত মাসে ঈদের ছুটি এবং কুরিয়ার সার্ভিস বন্ধ থাকায় সব বিখ্যাত জাতের আম রেকর্ড পরিমাণ কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে, যে কারণে চাষি ও ব্যবসায়ীরা বেশ হতাশ ছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন ফজলিই একমাত্র ভরসা।’
গত বছর এই সময়ে ফজলি আম আকার ও মানভেদে ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছিল।
সাহেব বাজার আম বাজারের খুচরা বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গোপালভোগ ও ক্ষীরসাপাতের মতো অন্যান্য জনপ্রিয় জাতের আম শেষ হওয়ার পর এখন ফজলিই বাজারে প্রধান। আম্রপালিও বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।’
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় আম একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। এই আমের মৌসুম বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।
আঞ্চলিক ফল গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, ‘এটি মৌসুমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং অনেককে বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেয়।’
স্থানীয় ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমের মৌসুম বানেশ্বরের সব শ্রেণির মানুষের জন্য আর্থিক সুবিধা বয়ে আনে। এমনকি একজন সাধারণ দিনমজুরও এই মৌসুমে দৈনিক ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা আয় করেন।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের(ডিএই) উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বাসসকে বলেন, এ বছর জেলার ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমি থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নওগাঁ ডিএই উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, জেলার ৩০ হাজার ৩শ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার টন।
তিনি অনুমান করছেন, এ বছর আম ব্যবসা থেকে জেলায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় হতে পারে।
উচ্চ মানের জাত এবং বিশাল আম বাগান থাকায় নওগাঁ একটি গুরুত্বপূর্ণ আম উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডিএই উপ-পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বাসসকে জানান, এ বছর জেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে এবং উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে ‘আমের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ব্যাপক আম চাষ এবং জাতীয় আম উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য জেলাটি পরিচিত।
আম গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেছুর রহমান বলেছেন, ‘গত বছর এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারে ১ হাজার ৩৩ টন আম রপ্তানি হয়েছে।’
এছাড়াও, এ বছর চীনে আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, একদল আমদানিকারককে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশ কয়েকটি আম বাগান পরিদর্শন করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আজিজুর রহমান বলেছেন, ‘এ বছর এই অঞ্চলে ৮৭ হাজার ৩০৭ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে, যেখানে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
তিনি আরো বলেন, এ বছর আমের ফলন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। বেশি আম উৎপাদন স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষের সুযোগ বাড়বে।
আজিজুর রহমান বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরা সেচ সমস্যার কারণে ধান চাষ কমিয়ে আম চাষে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, আম রপ্তানির সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ায় এবং বাজার ব্যবস্থাপনা ভালো হওয়ায় কৃষকরা আম চাষ বাড়াতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর, এই অঞ্চলের আম বাণিজ্যিকভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়।