মোশতাক আহমদ
ঢাকা, ১৫ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, তিনি ২৪ এর জুলাই আন্দোলনে সার্বক্ষণিক মাঠে ছিলেন।
তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় তিনি নিজে ‘ক্ষুব্ধ নারী সমাজ’ নামে একটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে ছাত্র জনতার সর্বশেষ বিজয় না আসা পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন। তার সঙ্গী সাথীদের অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এখনো অনেকেই সেই করুণ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিজ কক্ষে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তার সেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে এ কথা বলেন।
মৎস্য উপদেষ্টা বলেন,অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি পালন করছে। শুধু এই বর্ষপূর্তি নয়, সারা জীবন- বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের মানুষ ততদিন এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানান। পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসা এবং তাদের কর্মসংস্থান ও জীবন মান উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, তিনি ছাত্র জনতার আন্দোলনের বিজয় হাতে না আসা পর্যন্ত সর্বক্ষণ মাঠে ছিলেন। তিনি দেখেছেন- ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তাদের বাবা-মায়েরা কিভাবে সমভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
ফরিদা আখতার বলেন, আন্দোলনের মাঝামাঝি এক পর্যায়ে এমন হয়েছিল যে, তখন আমাদের নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা একে অপরকে ফোন করে কথা বলতাম, সারারাত অস্থিরতায় ঘুমাতে পারতামনা। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলামনা। চারদিকে ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ মানূষের উপর অত্যচার নির্যাতন, গুলি, ছাত্রলীগের হামলা। মানে এমন একটা নিষ্ঠুরতার চিত্র দেখছিলাম কিন্তু কিছু করাও যাচ্ছিল না।
তিনি বলেন, আমরা প্রথমে অনেক কিছু করার কথা ভাবছিলাম কিন্তু তাতেও অনেক রকম বাধা ছিল। আমরা শেষে কয়েকজন নারী মিলে একটা ‘ক্ষুব্ধ নারী সমাজ’ নাম দিয়ে একটা প্লাটফর্মের মতো করি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, নারী আন্দোলন কর্মী, শ্রমিক নেত্রীরা এসে জড়ো হতে শুরু করলেন। এক পর্যায়ে আমরা ভাবলাম, একটা প্রেস কনফারেন্স করব। তখন আমরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। এরপর আমরা ‘ক্ষুব্ধ নারী সমাজ’ এর পক্ষ থেকে রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটা প্রেস কনফারেন্স করি। প্রেস কনফারেন্সে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরি। তখন আমরা শুধু একটা কথায় বলেছি যে, চারিদিকে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। এটা নির্মম নিপীড়ন। এটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
ফরিদা আখতার বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর নিপীড়ন দেখে জুলাইয়ের শেষ দিকে আমরা অতিষ্ট হয়ে উঠছিলাম। দেশের মানুষের সাথে আমরা ক্ষুব্দ হয়ে উঠছিলাম। আমরা ধরে নিয়েছি নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদেও মাঠে নামতে হবে। আমাদের উপর ঝড়-ঝাপটা যা আসুক,সেটা মাথায় নিয়ে আমরা রাস্তায় অবস্থান নেব। এরমধ্যে শুনলাম হাইকোর্টের সামনে অনেকেই জড়ো হচ্ছে। তখন আমরা প্রেস কনফারেন্স করে রিপোর্টারস ইউনিটি থেকে বের হয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে এগুচ্ছি। সেখানে পুলিশ আমাদের আটকিয়ে দেয়।
পুলিশের বাধায় আমরা আর হাইকোর্টের দিকে যেতে পারলাম না। তখন দুপুর প্রায় ১২ টা। পুরুষ পুলিশের সাথে আমরা যখন সামনে এগুবার জন্য তর্ক করছি, এমন সময় আমাদেরকে মহিলঅ পুলিশ এসে ঘিরে ফেললো। আমাদের সামনে এগুতে না দিয়ে পুলিশ বললো, ওদিকে গোলাগুলি হবে যেতে পারবেননা। পরে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে পুলিশের বাধায় আমরা ফিরে আসলাম।
তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের শেষের দিকে আমরা শাহবাগে জড়ো হওয়ার জন্য মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগে দিকে আসতে থাকি। কিন্তু সেখানে দেখি, একদিকে পুলিশ অন্যদিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের উছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছে। ফলে আমরা শাহবাগে অবস্থানের চেষ্টা করেও পারলাম না। ওইদিন দুপুরে আমরা মোহাম্মদপুরে সাত মসজিদ রোডে একত্রিত হয়ে সমাবেশ করলাম। উন্মুক্ত রাস্তার উপরে আমাদের কর্মী সমর্থকরা মুহুর্মুহু শ্লোগানে মুখরিত করে তুললো। আমরা সমাবেশে বক্তব্য দিলাম। এ সময় মহিলা যুবলীগের একদল উছৃংখল নারী কর্মী মিছিল নিয়ে এসে আমাদের উপর হামলা করলো। আমরা তখন জীবনের নিরাপত্তায় শঙ্কিত হয়ে কোনমতে পাশের একটি ভবনের নিচে আশ্রয় নিলাম। সেখানেও তারা আমাদের উপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় এবং ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ এবং যুব মহিলালীগ কর্মীদের যৌথ হামলায় আমাদের অনেক কর্মী সেদিন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এত কিছুর পরও আমাদের আন্দোলন দমাতে পারেনি স্বৈরাচারী সরকারের পেটোয়া বাহিনী।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মরণ করে প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, সাতমসজিদ রোডের সেই ঘটনায় আমাদের নারী নেত্রী ও কর্মীরা পুলিশের পাশাপাশি যুবলীগ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলায় সবচেয়ে বেশী আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। যেই ভবনে আমরা আশ্রয় নিতে গিয়েছিলাম, পুলিশ ছাত্রলীগের যৌথ হামলা দেখে সেই ভবন এবং আশপাশের ভবনগুলোর সিকিউরিটি গার্ডরা ভবনের নিরাপত্তার স্বার্থে গেইট বন্ধ করে দিলো। ফলে আমাদের অনেক কর্মি ভবনগুলোতে আশ্রয় নিতে পারেনি। যারা একটু ঢুকতে দেরি করেছিল তাদের কয়েকজন পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছে। আমরা অনেকক্ষণ ভবনগুলোতে আটকে থাকার পর আস্তে আস্তে যার যার বাসার দিকে চলে যাই।
উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বলেন, আর তারপর আমরা একদিন সাত মসজিদ রোডে দাঁড়াইছি। সেদিন আবার খুবই বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু সবাই ওখানে দাঁড়িয়ে গান গাইলাম আমরা। ছেলে মেয়েরা এসে অভিনয় করছিল বৃষ্টিতে ভিজে।
উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বলেন, আমরা আরেকদিন শাহবাগে গিয়েছি। সেখানে দেখি ছেলে মেয়েরা পোস্টার লিখছে। আমাদেরকে দেখার পর তারা বললো আমাদের পাশে বসেন। আমরা যেহেতু একটু বয়স্ক, তারা আমাদের কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে পারলো। তাই আমাদের কষ্ট লাঘবের জন্য তারা বারবার বলছিল আপনারা বসেন। আমরা তাদে পাশে বসতেই ওরা খুশি হলো। আমরা আন্দোলনরত ছেলে মেয়েদের বললাম, তোমরা টেনশন করো না। তোমাদের জন্যই তো আমরা আসছি। তোমাদের বিজয় হবেই।
সেদিন পিজি হাসপাতালের ভিতর থেকে আগুন বেরোচ্ছে দেখে খবর নিলাম। ওখানে নাকি কয়েকটা গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ছাত্র বা সাধারণ জনগণ, রিক্সাওয়ালা, হকার শ্রমিক সত্যি সত্যি তারা এই আন্দোলনে মাঠে মাটি কামড় দিয়ে পড়েছিল। আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে তাদের কষ্টের সেই দৃশ্য আমরা চোখে দেখেছি।
তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় আমাদের একমাত্র বাহন ছিল রিক্সা বা সিএনজি। আমরা রিকশায় বসে তাদের কথা শুনতাম। রিক্সাওয়ালার মাধ্যমে বোঝা যেত জনগণ কি চাচ্ছে। তাদে কথায় একদম পরিষ্কার ছিল যে, জনগণ কি চায়। পরিবর্তন। এই রিক্সাওয়ালা-সিএনজি ড্রাইভারদের মনের ভাবটায় ছিল আমাদের বার্তা। এই কারণে আমি মনে করি যে, বাংলাদেশের ইতিহাস যদি সত্যিকার অর্থে লেখা হয়, তাহলে রিক্সাওয়ালাদেরকে নিয়েই একটা চ্যাপ্টার হওয়া উচিত।
ফরিদা আখতার জানান, তিনি আন্দোলনের সময় একদিন শহীদ মিনারে গিয়েছেন। শহীদ মিনারে তার চারপাশে স্কুলের ড্রেস পড়া মেয়েরা দাঁড়ানো। তিনি বললেন, তোমরা এসেছো, ওরা সবাই খুব খুশি। পরে দেখলাম আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাবা- মা। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি তাদের বাবা-মাদের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন গতি পেয়েছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষ জেগে উঠেছে। বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের গণতন্ত্রেও লড়াইয়ে জাগিয়ে তুলেছে।
তিনি বলেন, আন্দোলনে বাবা মায়েরা যে ভূমিকাটা রেখেছে এটা তিনি রাজপথে স্বচক্ষে দেখে অভিভূত হয়েছেন। একজন বাবা কোথাও সরকারি চাকরিজীবী, কোথাও ব্যবসায়ী, কোথাও মৎস্যজীবী। কিন্তু আন্দোলনের পুরোটা সময় তিনি আন্দোলনকারী সন্তানের বাবা হিসেবে মাঠে ছিলেন। এজন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মায়েদের পাশাপাশি বাবাদের ধন্যবাদ জানান তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা জানান, জুলাই গণ আন্দোলনে শহীদ যোদ্ধাদের স্মরণে তার মন্ত্রণালয় জুলাই আন্দোলনের আবহে বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতি দিয়ে সাজানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, আহতদের কথা আমরা হয়তো অনেকেই জানি। কিন্তু এমনও কিছু আহত আছে জুলাই অভ্যুত্থানে যাদেরকে আমরা হয়তো সেভাবে চিনি নাই। তার পরিচিত ২৫ বছর বয়সের এক যুবকের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, সেই যুবকটি পিঠে এত বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে যে, এখন সে পাঁচ কেজি ওজনও হাতে তুলে নিতে পারেনা।
আমাদের চেষ্টা আছে, এ ধরনের আহতদের নিয়েও কাজ করব। তাদের উন্নয়নের জন্য আমরা সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখব।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬০শতাংশ হলো ৩০ থেকে ৫০ বয়সের মধ্যে। তাই আগামীর উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ সব যুবক যুবতীদের কথা মাথায় রেখে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজাতে হবে। আমি নিজেও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে কৃতজ্ঞ মনে করব।