বিয়ের মেহেদী হাতেই প্ল্যাকার্ড ধরেছি, টিয়ারশেল খেয়েছি : লামিয়া ইসলাম

বাসস
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৬:৩০ আপডেট: : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৭:১৭
লামিয়া ইসলাম। ছবি: বাসস

\ অর্বাক আদিত্য \

ঢাকা, ১৫ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): লামিয়া ইসলাম, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম যোদ্ধা। তিনি ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন।  অনেক কম বয়সেই রাজনীতির জটিল বইগুলো অধ্যয়ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক বর্ষে পড়ছেন এবং রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বিশেষ আয়োজনে নেওয়া সাক্ষাৎকারে এই জুলাই সে সময়ের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন অর্বাক আদিত্য।

বাসস: নারী হিসেবে রাজনীতিতে আসায় কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?

লামিয়া ইসলাম: রাজনীতিতে এসেছি রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের স্বপ্ন নিয়ে। আর এই সংস্কার কেউ এসে করে দেবে না, আমাদের নিজেদেরই সেই সংস্কার করতে হবে।  জন্মের পর থেকে আমাদের দেশটাকে যে লুটপাট করা হয়েছে, বলা চলে তা ‘সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃত’। আইনের নানান ফাঁকফোকর ও মারপ্যাচই কাঠামোগতভাবে এই দেশের সরকারকে রাষ্ট্রের সেবক নয়, শোষকে পরিণত করেছে। ফলে এই পুরো ব্যবস্থাপনার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।  রাষ্ট্রটাকে আক্ষরিক অর্থে জনগণের  করে গড়ে তোলার জন্য রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি। আর আমি যখন রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিই, সেই সময়টা বাংলাদেশে চূড়ান্ত ফ্যাসিজমের সময়। কেউ তার নিজের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে পারেন না। কেউ কথা বললেই, তাকে ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। 

বাসস: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হলেন?

লামিয়া ইসলাম: যেহেতু আমি আগে থেকেই রাজনীতির মাঠে লড়াই সংগ্রামে যুক্ত ছিলাম। রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের সাথে রাজনীতি করি। এর আগে আমরা আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে নানা সময়ে যুগপৎভাবে  রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছি। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হলো, তখন থেকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবেই যুক্ত থেকেছি। আমরা বিশ্বাস করতাম, আমাদের ঐক্যবদ্ধতাই আওয়ামী জাহেলিয়াত থেকে আমাদের মুক্ত করবে। ফলে যখনই আমাদের এমন কোনো সুযোগ তৈরি হয়েছে, আমরা তাতে অংশ নিয়েছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এমনই একটি প্ল্যাটফর্ম যেখান থেকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। এই ছাতা আমাদের এক করেছিল।  আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল জুনে। তখন থেকেই এতে যুক্ত থাকি। রাজপথে আসি, মিছিলে যুক্ত হই। নানা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রাখি।  এই আন্দোলন চলাকালেই আমার বিয়ে হয়।

বাসস: হ্যাঁ, বিষয়টি আপনি ফেসবুকে লিখেছেন, বিয়ের দুইদিন পরই আপনি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

লামিয়া ইসলাম: তথ্যে একটু ভুল আছে। আমি বিয়ের দুইদিন পর আন্দোলনে যুক্ত হইনি বরং বিয়ের জন্য দুইদিন বিরতি নিয়েছিলাম। আমি আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিলাম। ১২ জুলাই আমার বিয়ে হয়। তার আগে আমি বিয়ের কেনাকাটা করে শপিং ব্যাগ হাতে নিয়েই মিছিল করেছি। ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেছি। বিয়ে এবং তারপরের দিন আমি সশরীরে আন্দোলনের মাঠে থাকতে পারিনি। অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরব ছিলাম। বিয়ের দুইদিনের মাথায় আর রাস্তায় না নেমে থাকতে পারিনি। আপনি নিশ্চয় জানেন, একজন নববধুর পক্ষে শ্বশুরবাড়ি থেকে এই সময়টা বের হওয়া কতটা কঠিন। ফলে আমাকে শ্বশুড়বাড়ি থেকে মিথ্যা অযুহাত দিয়ে বের হতে হতো। এ ব্যাপারে আমার বরের সহযোগিতা পেয়েছি। বিয়ের মেহেদী তখনও তরতাজা। টকটকে। ফ্যাকাশে হয়নি। অথচ আমি চলে গেছি মিছিলে। বিয়ের মেহেদী হাতেই প্ল্যাকার্ড ধরেছি, টিয়ার শেল খেয়েছি। এই আবেগ আসলে এখন বলে বোঝানো যাবে না। মুক্তির নেশা আসলে আপনার সামনের সবকিছুকে তুচ্ছ করে তুলবে।

ওই সময়টা খুবই অস্থিরতার ভেতর দিয়ে গেছে। তখন পুলিশ ছাত্র দেখলেই তাদের মোবাইল ফোন চেক করতো। আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা দেখতো। তখন একটা কৌশল নেওয়া শুরু করি। বাসা থেকে যখন বের হতাম, ফোন ফ্ল্যাশ মেরে বের হতাম। আর একটা কাগজে নিজের নাম, মায়ের ফোন নম্বর, হাসবেন্ডের ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা লিখে নিতাম। আমি তো জানি না, বেঁচে ফিরবো কিনা। দেখা গেল গুলি খেয়ে রাস্তায় আমার লাশ পড়ে আছে।  অন্তত লাশটা যেন আমার পরিবার পায়, এ জন্য এটা করতাম।

বাসস: ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যের সঙ্গে ছিলেন। জুলাইয়ের আন্দোলনে আপনার সেই অভিজ্ঞতাকে কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন?

লামিয়া ইসলাম: জ্বি, আমরা বেশ কয়েকটি সংগঠন মিলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যে ছিলাম। কিন্তু জুলাই আসলে সবকিছু থেকে আলাদা ছিল। মানুষের ভেতর ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এখানে আসলে আমাদের আন্দোলনটাকে শুধু কন্টিনিউ করে যেতে হয়েছে; আর কিছু না। আমরা জানতাম, যদি আমরা মাঠে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারি; তাহলে আরও বেশি মানুষ এতে অংশগ্রহণ করবেন। রাস্তায় নেমে আসবেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের নির্যাতন-নিপীড়ন আর আন্দোলন দমনে তাদের যে দুর্বৃত্তায়ন- তা যেকোনো মানুষকেই ছুঁয়ে গেছে। মানুষ তার সন্তানকে রক্ষা করার জন্য মাঠে নেমেছে, বোন তার ভাইকে রক্ষা করার জন্য মাঠে নেমেছে। এই যে মানুষের স্রোত নামতে শুরু করেছিল, তা আটকানোর ক্ষমতা কারো ছিল না। আন্দোলনের ক্ষেত্রে সশস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ানোটাই কাজে লেগেছে। আপনি সাহস করে দাঁড়িয়ে থাকবেন, দেখবেন আপনার সাথে এসে অনেকে দাঁড়িয়ে গেছে। আপনি তাদের ধাওয়া দিতে গিয়ে দেখবেন কোথা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে আপনার সাথে যুক্ত হয়েছে।

বাসস: জুলাইয়ের কোন ঘটনা বা স্মৃতি কী আপনাকে বারবার নাড়া দেয়?

লামিয়া ইসলাম: ২ আগস্ট শাহাবাগে একটা সংঘর্ষের মধ্যে পড়ি। সেখানে গুলি করা হচ্ছিল। আমার চোখের সামনেই দুইজন মানুষ রাস্তায় পড়ে গেল।  চোখের সামনে মৃত্যু। সেই দৃশ্য এখনো মনে পড়লে শিউরে উঠি।

বাসস: রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে আপনারা (রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন) দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। এখন সেই সুযোগ এসেছে।  কেমন রাষ্ট্র দেখতে চান?

লামিয়া ইসলাম: আমরা আসলে জনগণের রাষ্ট্র গড়তে চাই। এমন একটা রাষ্ট্র যেখানে সরকার আইনের ঊর্ধ্বে না বরং এমন আইন করতে হবে যেন যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের জবাবদিহিতে বাধ্য করা যাবে। ক্ষমতা কোনো একক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত থাকবে না। যেন কেউ চাইলেই টাকা পাচার করতে না পারে, নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য যেন একটি নিরাপদ দেশ গড়তে পারি। প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সরকার। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাজনীতি থাকবে তবে তা যেন ক্যাডারভিত্তিক না হয়। ক্ষমতাবান হবেন নাগরিকরা। জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণ করতে পারলেই আমরা আসলে সত্যিকার অর্থে একটা নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে পারবো।

বাসস: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

লামিয়া ইসলাম: গণঅভ্যুত্থানের একটি বড় প্রত্যাশা ছিল, রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। পুরোনো ব্যবস্থাপনা বাতিল, জনবিরোধী বিধিবিধান বাতিল, ভেঙে ফেলা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন।  তবে এসবের বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তবে সময় এখনো শেষ হয়নি। অবিলম্বে জুলাইয়ের আহতদের সার্বিক চিকিৎসা চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং জুলাই সনদ দিতে হবে।  সংবিধান ও আইনি কাঠামোর সংস্কার করতে হবে। ফ্যাসিবাদের বীজ যেখানে যেখানে আছে তা উৎখাত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে বর্তমান সরকারকেও তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয়ে জনগণের সামনে জবাবদিহি করতে হবে।

বাসস : আপনাকে ধন্যবাদ।

লামিয়া ইসলাম: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
শহীদ আবু সাঈদ ফিদে র‌্যাপিড রেটিং দাবা কাল শুরু
ই-সফট এরিনা চেস ক্লাব ও অগ্রনী ব্যাংক যুগ্মভাবে শীর্ষে
শিশু হাসপাতালে পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসক নিয়োগের অভিযোগে দুদকের অভিযান
মাঠ বদলের ম্যাচে শান্তির হ্যাটট্রিকে বাংলাদেশের জয়
পুমার সাথে ১ বিলিয়ন পাউন্ডের চুক্তি করলো ম্যান সিটি
এএফডব্লিউসি প্রশিক্ষণার্থীদের পুলিশ সদরদপ্তর পরিদর্শন
দা হান্ড্রেডে দল পেলেন অভিজ্ঞ এন্ডারসন
নিষিদ্ধ সংগঠনের কারও সঙ্গে আঁতাতের গন্ধ পেলে ছাড় দেয়া হবে না: ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ
উচ্চতর গ্রেড বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
নীতি সুদহার কমিয়ে ৮ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
১০