দিনাজপুরের মৎস্য খামারিদের ভাগ্য বদলে দিচ্ছে দেশি টেংরার চাষ

বাসস
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৭:৫১
দিনাজপুরের মৎস্য খামারিদের ভাগ্য বদলে দিচ্ছে দেশি টেংরার চাষ। ছবি :বাসস

 রোস্তম আলী মন্ডল

দিনাজপুর, ১২ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): আধুনিক প্রযুক্তিতে দেশি টেংরা মাছ চাষ করে নিজেদের ভাগ্য বদলাচ্ছেন জেলার মৎস্য চাষিরা। দেশি টেংরার পোনা উৎপাদনে সফল উদ্যোক্তা মো. মনির হোসেন (৩০)এর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেলার অনেক মৎস্য চাষিই এখন দেশি টেংরা চাষে বিনিয়োগ করছেন। 

জানা যায়, আশপাশ ও দূরদূরান্ত থেকে মৎস্য খামারিরা মনিরের কাছ থেকে টেংরা মাছের পোনা নিয়ে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ টেংরা মাছ চাষ করছেন। তার দেশীয় টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনের সাফল্য এখন অনেক মৎস্য চাষির কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ টেংরা মাছের কাঁটা কম হওয়ায় অনেকের কাছেই প্রিয় মাছ এটি। তাই বাজারে এই  মাছের দাম একটু বেশিই। জলাশয় ও নদী থেকে নানা কারণে হারিয়ে যাওয়া দেশি টেংরা মাছ এখন পুকুরে চাষ হচ্ছে। আর এই টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের ইন্দ্রপুর গ্রামের একটি পুকুরে।

টেংরা চাষে সফল উদ্যোক্তা যুবক মো. মনির হোসেন বাসসকে জানান, প্রতিবেশী মোক্তার আলীর কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকায় ৫০ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে গত বছর জুন মাসে তিনি দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন শুরু করেন। আধুনিক প্রযুক্তিতে টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন করে গত ৬ মাসে বিক্রির মাধ্যমে লাভ করেছেন প্রায় দুই লাখ টাকা।

দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের ইন্দ্রপুর গ্রামের নূরুল হকের পুত্র মনির হোসেন (৩০)। বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও পুত্রসহ ৬ সদস্য নিয়ে তাদের সুখী পরিবার। পারিবারিক সূত্রে পিতার কৃষি কাজের হাল ধরতে হয় তাকে। মনির হোসেন বেশিদূর পড়াশোনা করতে না পারলেও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। 

মনির হোসেন জানান, ২০২১ সালে ৬ মাসব্যাপী দিনাজপুর যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মৎস্য চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ছোট্ট জলাশয়ে মাছ চাষ শুরু করে লাভের সম্ভাবনা বুঝতে পারেন। এতে মাছ চাষের প্রতি তার আগ্রহ প্রবলভাবে বেড়ে যায় এবং কৃষি কাজের পাশাপাশি মাছ চাষ শুরু করেন। এরপরই মনির হোসেন দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেন। 

তিনি জানান, ৫০ শতক জমির পুকুরে টেংরা পোনা উৎপাদনে সর্বসাকুল্যে তার খরচ হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এক বছরে মাছ বিক্রি করেন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। নতুন করে তিনি চলতি বছরে আরও ২ একর পুকুর লিজ নিয়েছেন। বর্তমানে তার খামারে ৪ জন লোকের স্থায়ী কর্মসংস্থান হয়েছে। ৭ জন লোক অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন। মাছের পোনা উৎপাদনের পাশাপাশি পুকুরের চার ধারে রোপণ করেছেন,ফলজ গাছ ও শাক-সবজি। 

মনির হোসেনের মৎস্য খামার এখন জেলাবাসীর কাছে আদর্শ খামার হয়ে উঠেছে। আশ-পাশ ও দূরদূরান্ত থেকে মৎস্য বিক্রেতা ও খামারিরা তার কাছ টেংরা মাছের পোনা ক্রয় করে নিয়ে যায়। তারাও অন্যান্য মাছের পরিবর্তে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ টেংরা মাছ চাষ করছেন। তার এই দেশীয় টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনের সাফল্য এখন অনেককে মৎস্য চাষে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।

যুবক মুনিরের উৎপাদিত টেংরা মাছের পোনা নিতে আসা মৎস্য খামারি রিয়াজুল ইসলাম বাসসকে জানান, তিনি আগে অন্য মাছ চাষ করতেন। এখন দেশি টেংরা মাছ চাষ করছেন। অন্য মাছের চেয়ে টেংরা মাছ চাষে লাভ অনেক বেশি।

মাছের পোনা বিক্রেতা আজগার আলী বলেন, ‘মুনিরের পুকুর থেকে সপ্তাহে ৩/৪ দিন টেংরা মাছের পোনা হাঁড়িতে করে এনে বাইরে বিক্রি করি। এই টেংরা মাছের পোনার চাহিদা বেশি। অনেকে আগে থেকেই পোনার অর্ডার দেই। টেংরা মাছের পোনা বিক্রি করে আমার ভালো লাভ থাকে। এ জন্যই পোনা বিক্রি করি।’

বেসরকারি সাহায্য সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর দিনাজপুর জেলা মৎস্য গবেষণা কর্মকর্তা মো. রায়হানুল ইসলাম জানান, সরকারি মৎস্য বিভাগের পাশাপাশি, তাদের কার্যালয় থেকে উদ্যোক্তা যুবক মনির হোসেনকে দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনে প্রথম থেকেই সহায়তা করা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, বেসরকারি সংস্থা ‘গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের’ সূচনা মহিলা সমিতি জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার-ভবের বাজার শাখার কারিগরি সহযোগিতা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে মনির হোসেনকে সহায়তা করছে। এর মাধ্যমে মনির টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারছেন।

গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, ‘টেংরা মাছ খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় বাজারে এর দাম অন্য মাছের তুলনায় বেশি। এ মাছ চাষ করতে পারলে তুলনামূলক ভাবে বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়। ফলে পুকুর মালিকদের আয় বৃদ্ধিতে দেশি টেংরা মাছ বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে। শিক্ষিত বেকার যুবকেরা আধুনিক পদ্ধতিতে টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন ও মাছ চাষ করে বেকারত্ব ঘোচাতে পারছেন। গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র টেংরা পোনা উৎপাদনে শুরু থেকেই মনির হোসেন কে সহায়তা করে আসছে।'

দিনাজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা পূরবী রাণী রায় বলেন, উদ্যোক্তা যুবক মনির হোসেন আমাদের সৃষ্টি। বেকার যুবকদের চাকুরির পিছনে না ঘুরে মাছ চাষের জন্য আহ্বান জানিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। পুকুরে টেংরা চাষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। যদি টেংরা মাছের সঠিক পরিচর্যা করা যায় তাহলে একেকটি এলাকা থেকে যে পরিমাণ মাছের জোগান আসবে তাতেই দেশি মাছের চাহিদার একটি বড়ো অংশ পূরণ হবে। 

তিনি বলেন, টেংরা চাষ করে যেমন স্বাবলম্বী হওয়া যাবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে একে একটি লাভ জনক খাতে পরিণত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশি টেংরার পোনা উৎপাদনে সরকারের পাশাপাশি পিকেএসএফসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে।

মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, উদ্যোক্তা মনির হোসেনের দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন করায় অনেকের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। এই উদ্যোগ জেলার আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মাছ উৎপাদনে জাতীয় র্অথনীতিতে ভূমিকা রাখবে। 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
কৃষক লীগের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য গ্রেফতার
পিরোজপুরে সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে  দুদকের মামলা
সেবা প্রদানে হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুদকের অভিযান
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে ৩৩১ দেশি সংস্থার আবেদন
দেশব্যাপী বিভ্রাটের পর ইরাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু
ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মহফুজা খানম আর নেই
পিতার জবানবন্দি : একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে পাগলের মতো জীবন যাপন করছি
পি আর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে : চরমোনাইর পীর 
জনগণের রায় নিয়ে সরকার গঠন করলে মিলে-মিশে দেশ পরিচালনা করবে বিএনপি : তারেক রহমান 
প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম উদ্বোধন করতে কানাডা যাচ্ছেন সিইসি
১০