ঢাকা, ২৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : সারাদেশে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে জ্বরের প্রকোপ। এই জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে ছোট-বড় সবাই। মৌসুমি এই জ্বরে কাবু হচ্ছেন আক্রান্তরা।
জ্বরের সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথাসহ নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। আক্রান্তদের ভুগতে হচ্ছে এক থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। জ্বর ভালো হওয়ার পরও শারীরিক দুর্বলতা থাকছে দীর্ঘদিন। শিশু, বয়স্ক, শ্বাসকষ্টজনিত রোগী এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বেশি।
জ্বর হলেই চিন্তায় আসে, ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া হয়েছে। তবে এ বছর বেশি ভোগাচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, জ্বর-সর্দি, কাশি, মাথা-গলা ও শরীর ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের ৫৭ শতাংশই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ। দুই থেকে তিন দিনের জ্বর নিয়ে আসছেন রোগীরা। একজনের জ্বর হলে পরিবারের অন্যরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। উপসর্গও প্রায় একই রকম। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ ভাইরাস ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত জ্বরে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে- হালকা উপসর্গ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, মাস্ক পরা ও গরম তরল খাবার খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া জ্বরের প্রথম তিন দিনের মধ্যে কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কয়েকটি হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশ কিছুদিন যাবত হাসপাতালগুলোতে জ্বর নিয়ে আসার রোগীর চাপ বেড়েছে। গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে বেড়েছে জ্বরের ওষুধের চাহিদা। এ সময়ে বেড়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মো. মুশতাক হোসেন জানান, এ বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি হচ্ছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াও বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই সময়ে জ্বর নিয়ে ভয় না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জ্বর হলে অস্থির হওয়া যাবে না। এই সময়ে ঘন ঘন তরল খাবার খেতে হবে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে ১৯টি হাসপাতালে তীব্র জ্বর, কাশি এবং শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ে আসা ১ হাজার ৮৪৭ জন রোগীর ওপর আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবি ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স পরিচালনা করে। তাতে দেখা গেছে, আক্রান্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। প্রতি ১০ জনে প্রায় ৬ জন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। ২০২৩ সালে এই হার ছিল অনেক কম; ২৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল জুন মাসে; ৩৭ শতাংশ। ২০০৭ সালের পর থেকে এটিই এক মাসে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শ্বাসযন্ত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে মৌসুমি ফ্লু হয়, যা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন, তবে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণরা গুরুতরভাবে আক্রান্ত হতে পারেন।
জনস্বাস্থ্যবিদ লেলিন চৌধুরী বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা এক ধরনের ভাইরাস।এই ভাইরাসজনিত জ্বর মৌসুমি জ্বরের মতো। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে জ্বর অনেক বেশি বা কম হতে পারে। শরীরে ব্যথা থাকে। তীব্র মাথাব্যথা থাকে। কাশি থাকতে পারে। খুব দুর্বল লাগতে পারে। সর্দি হতেও পারে, না-ও হতে পারে। অনেকটা করোনা বা ডেঙ্গুর লক্ষণের মতো। কখনো কখনো শরীরে র্যাশও হয়। কিন্তু রক্তক্ষরণ হয় না।
ইনফ্লুয়েঞ্জার নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। ডেঙ্গু করোনার মতো এই ভাইরাস প্রাণঘাতী নয়।
আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার (ফ্লু) মৌসুম। সে জন্য ফ্লু মৌসুমে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি (মাস্ক পরা, মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া, হাত ধোয়া ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে। প্রতিবছর ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের (৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যারা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শ্বাসকষ্টের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, গর্ভবতী নারী, ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু) জন্য ফ্লু টিকা নেওয়া জরুরি। কোনো কারণে ফ্লু মৌসুম শুরুর আগে টিকা নিতে না পারলে মৌসুম শুরু হওয়ার পরেও টিকা নেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে সর্দি-কাশি নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল ৪ হাজার ২৪ জন শিশু। জুলাই মাসে তা বেড়ে হয় ৬ হাজার ২৫৫ জন। ওই মাসে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৯ হাজার ৩৬৭ জন শিশু চিকিৎসা নেয়। তাদের ৬ হাজার ২৫৫ জন, অর্থাৎ ৬৬.৬৭ শতাংশই সর্দি-জ্বরে ভুগেছে।
আগস্ট মাসের প্রথম ২০ দিনে এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২ হাজার ২২৯ জন শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৯২১ জন, অর্থাৎ ৮৬ দশমিক ১৮ শতাংশ এসেছে সর্দি-জ্বর নিয়ে।
এদিকে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুমে সুস্থ থাকতে সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করা, কাশি শিষ্টাচার মেনে চলা, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে সুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা, যথাসম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলা, প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে আইইডিসিআর।