এনামুল হক এনা
পটুয়াখালী, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার রাঙ্গাবালী, গলাচিপা ও বাউফলে ফসলি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। এর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের ওপর। ফলে বিলুপ্তির পথে উপকূলীয় অঞ্চলের দেশি প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্থানীয় কৃষকরা জমিতে ফলন বাড়াতে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। বর্ষার সময় এ বিষাক্ত পদার্থগুলো বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদী-নালা, খাল ও পুকুরে মিশে যাচ্ছে। এতে পানির প্রাণবৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে বিশেষ করে মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে এবং প্রজনন ও জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে স্থানীয়ভাবে পরিচিত নানা দেশি মাছ যেমন- পুঁটি, কৈ, শিং, মাগুর, পাবদা, টাকি, চিংরি, বাইম, বেদা, গজার, বেলে মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, গলাচিপা ও বাউফল উপজেলার চারপাশে নদীবেষ্টিত এলাকা। কিন্তু এখন আর আগের মতো দেশি প্রজাতির মাছের দেখা মেলে না। জেলার বিভিন্ন উপজেলার মানুষ নদীবেষ্টিত উপজেলাগুলোর মাছের প্রশংসায় থাকতেন পঞ্চমুখ। অথচ আজ মাছে ভাতে বাঙ্গালি বলা সেই প্রবাদ হারিয়ে যেতে বসেছে। দেখা দিয়েছে মাছের অকাল।
রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের মৎস্য শিকারী আবদুল করিম (৫০) বলেন, এক সময় খাল বিল নদী নালায় প্রচুর মাছ মিলতো, যখন ফসলি জমিতে হালচাষ দিতো তখন হালের সাথে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এখন আর সেই মাছ পাওয়া যায় না, প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাউফলের কনকদিয়া ইউনিয়নের মাছ শিকারী কেরামত আলী (৫৫) বলেন, আগে জাল মারলে জালে মাছ ভরে উঠতো এখন আর উঠে না তেমন। দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষণাবেক্ষণ যদি এখন করা না হয়, তাহলে এই মাছ হারিয়ে যাবে। তাই এই মাছ টিকিয়ে রাখার আহ্বান সচেতন মহলের প্রতি।
রাঙ্গাবালী, গলাচিপা ও বাউফলে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য দেশি মাছ। এই মাছের সঙ্গে তাদের জীবিকা, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির সম্পর্ক। তাই পরিবেশ রক্ষা ও দেশীয় মাছের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এখনই জরুরি পদক্ষেপ দরকার। এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ও সচেতন মহল।
বাউফল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান বাচ্চু (৫৩) এ বিষয়ে বলেন, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দেশীয় প্রজাতির মাছের নাম। তাই এই মাছ রক্ষা করতে সকলের এগিয়ে আসতে হবে। অবিলম্বে সচেতনতা বৃদ্ধি, জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎসাহ এবং জলাশয় রক্ষা করে টেকসই কৃষিনীতি গ্রহণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে দেশীয় মাছ হারিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে রাঙ্গাবালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ফসলি জমিতে রাসায়নিক ও কীটনাশক মিশ্রিত খাবার খেয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্ত হতে চলছে। এমন সময় আসবে এসব মাছ আর চোখে পড়বে না। আমাদের মৎস্য অধিদপ্তর এসব দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন সহায়তা ও পরামর্শ দিচ্ছে। যাতে এসব দেশীয় মাছ ধরে রাখা যায়।
রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, অধিক উৎপাদনের আশায় রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। এতে দেশীয় মাছের ক্ষতি হচ্ছে। তবে আমরা মাঠ পর্যায় কৃষকদের ফসলি জমিতে গাছের ডাল পুতে রাখা, রাতে আলোক ফাঁদ তৈরি করা এবং নীমপাতা, মেহগনি গাছের ফল বেটে (মিহি) করে একসাথে করে ফসলি জমিতে দিতে পরামর্শ দেই, যাতে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যায়।
এ বিষয়ে বাউফল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মিলন বলেন, মাটিতে অধিক পরিমান জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে রাসায়নিক সার ব্যবহার কমানো যায়। একইসাথে জমিতে অধিক ফলন ধরে রাখা সম্ভব। পাশাপাশি রাসায়নিক সারের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমরা রেহাই পাবো। তবে কৃষকদের জৈব পদ্ধতির দিকে ধীরে ধীরে আগানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাউফল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে কৃষি জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জলাশয়ে পানি সংকট, মৎস্য অভয়াশ্রম কম থাকা, মৎস্য আবাস ভূমির চ্যানেল বন্ধ হওয়া, অবৈধ জাল ও কিটনাশক ব্যবহারে নির্বিচারে মাছ ধরায় মাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা কারেন্ট জাল ও চায়না জালের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছি। যারা জলমহাল ইজারা নেন তারা যেন পানি সেচে মাছ না ধরে সেই প্রচারণা চালাচ্ছি। প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মৎস্য আইন বাস্তবায়নে কাজ করছি। বিলুপ্ত মাছ পুনরুদ্ধারে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন।