আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ৮ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : ‘মা’ ইলিশ ধরতে সরকারের বেঁধে দেওয়া ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা সফলভাবে পরিচালিত হলেও কিছু কিছু এলাকার গুটিসংখ্যক জেলেরা অমান্য করছেন।
গত দুইদিনে এমন চিত্র দেখা গেছে, উপকূলীয় জেলা ভোলার বিভিন্ন নদ-নদীর তীরবর্তী প্রান্তিক জনপদে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারণ হিসেবে জেলেদের বক্তব্য হচ্ছে-অসাধু মহাজনদের দাদন পরিশোধের চাপে তারা মাছ ধরতে নদীতে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
তারা জানান, নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে আমাদের কাছ থেকে ৪-২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ঋণের কিস্তি না নিতে সরকার বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিওগুলোকে নিষেধ করলেও এমন নির্দেশনা মহাজনদের দাদনের বেলায় দেয়া হয়নি।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ‘মা’ ইলিশ ধরার অপরাধে গতকাল মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত ভোলার লালমোহন উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে ১২ জেলেকে আটক করা হয়। এ সময় জব্দ করা হয় ৫ হাজার মিটার অবৈধ জাল এবং ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১৫ কেজি মাছ। পরে বিকেলে উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের নাজিরপুর মৎস্যঘাটে আটককৃতদের মধ্যে ১২ জেলেকে পাঁচদিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন, লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহ আজিজ।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন-লালমোহনের বদরপুর ইউনিয়নের মো. লাদেন (২৫), মো. সাকিল (৩০), মো. সোহেল (৩০), মো. শরিফ (২৫), মো. টিটু (৩০), মো. সাকিল (৩০), রাশেদ (৩৫), মো. কিবরিয়া (২৮), শাহাবুদ্দীন (২৫), ফরহাদ (২১), মো. মফিজল (৩০), মো. কুট্টি (২৮) ও মো. সাকিল (২৫)। দণ্ডপ্রাপ্ত জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা অমান্যের নেপথ্যে এসব ঘটনা।
তাদের সকলের সাথে পৃথক পৃথকভাবে জানতে চাইলে তারা জানান, নিবন্ধিত জেলেদের তালিকায় আমাদের কারোর নাম নেই। আমরা সরকারের প্রণোদনার চাল পাইনা, কিন্তু দাদনের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। জেলেরা আরও জানান, এনজিও এবং ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়েছেন শুধু তাদের কাছ থেকেই ঋণের কিস্তি নেয়া বন্ধ থাকবে। এমন যুক্তি দেখিয়ে মহাজনেরা আমাদের কাছ থেকে কিস্তি নেয়া বন্ধ রাখেনি। ত্ইা জেল, জরিমানা আর শাস্তির ঝুঁকি নিয়েই আমরা মহাজনের লাল চক্ষু আর নির্যাতন থেকে বাঁচতে ইলিশ শিকারে নদীতে নেমেছি।
দণ্ডপ্রাপ্ত জেলে রাশেদ মাঝি, কিবরিয়া ও সাকিল মাঝি বলেন, বিগত আ'লীগ সরকারের আমলে 'মা' ইলিশ কিম্বা জাটকা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিতো। কিন্তু সেই দলের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন সাহেবের নির্দেশে আমরা নদীতে জাল বাইতাম। মাছ ধরতাম প্রচুর। আমাগো আয়ের অর্ধেক এমপি সাহেবকে দিলেই সব মাফ হয়ে যেতো। তখন নদীতে মৎস্য অফিসের স্যারেরা পুলিশ নিয়ে অভিযানের নাটক করতো, আমাগোরে ধরতোনা। কিন্তু এইবার এমন কঠিন অভিযান হবে সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। তাছাড়া মহাজনের দাদনের টাকা শোধ না করলে মাস্তান-লাঠিয়াল নিয়ে ওরা আমাদের চাল-চুলা সবই লুটপাট কইরা নিয়া যায়। আমরা মহাজনের কাছে জিম্মি হয়া আছি।
ওইদিনের অভিযানে সেখানে এক জেলেকে ১ হাজার টাকা জরিমানা এবং তিনজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অপরদিকে গতকালের জব্দকৃত জাল আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস আর মাছ মাদরাসা এবং এতিমখানায় বিতরণ করা হয়।
এ সময় লালমোহন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলী আহমদ আখন্দ, থানা পুলিশের সদস্যগণসহ মৎস্য অফিসের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো.ইকবাল হোসেন বাসস'কে জানান, গত ৪ অক্টোবর থেকে মৎস্য বিভাগ ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে আজ বুধবার পর্যন্ত জেলার ৭ উপজেলায় ১০৪ টি অভিযান পরিচালনা করেছেন। এসময় বিশেষ টাস্কফোর্স জেলার বিভিন্ন উপজেলার ২৬১ টি মাছঘাট,৭০ টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, ৪০৭ টি আড়ৎ এবং ২৩৩ টি বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে ৩৬ কেজি 'মা' ইলিশ জব্দ এবং ৪ হাজার ৯২৭মিটার জাল আটক করা হয়। জব্দ করা হয় ৩২১ কেজি 'মা' ইলিশ।
ওদিকে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের এক চিঠিতে উপকূলীয় এলাকায় নিবন্ধিত জেলেদের মাঝে সরকারের বরাদ্দকৃত বিশেষ প্রণোদনার (ভিজিএফ) চাল খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বন্টনে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর ডিসিদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান, ভোলা মৎস্য অধিদপ্তর।
অন্যদিকে চলতি 'মা' সংরক্ষণ অভিযানে নিষেধাজ্ঞা সফল করতে উপকূলের সাগর মোহনা ও নদনদীগুলোতে- নৌপুলিশ, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর যৌথ টহল অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। সব মিলিয়ে 'মা' ইলিশ রক্ষায় রেড অ্যালার্ট পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে করছেন জেলাগুলোর মৎস্য সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, ভোলায় সরকার নিবন্ধিত জেলেদের সংখ্যা ১ লাখ ৭১ হাজার এবং এর বাইরেও আরো দুই লক্ষাধিক জেলে রয়েছে বলে মৎস্যজীবী সংগঠনগুলোর নেতাদের দাবি।